West Bengal Panchayat Election 2023

নিয়োগ দুর্নীতিতে জেলবন্দি নেতাদের পাড়ায় কেমন হল পঞ্চায়েতের ফল? খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন

কাদায় পদ্ম ফোটেনি, বরং ঘাসফুলই মাথাচাড়া দিয়েছে। তার প্রমাণ রাজ্যে সর্বাধিক আলোচিত নিয়োগ মামলার জেলবন্দি কয়েকজন বর্তমান এবং বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতার পাড়ার ফল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩ ০৯:০১
Share:

বাঁ দিক থেকে মানিক ভট্টাচার্য, জীবনকৃষ্ণ সাহা, কুন্তল ঘোষ এবং শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

কিছু দিন আগে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিরোধীদের কটাক্ষের সুরেই বলেছিলেন, ‘‘যত কাদা ছুড়বে, তত পদ্ম ফুটবে।’’ লোকসভায় শাসকদলকে আক্রমণরত কংগ্রেসকেই এ কথা বলেছিলেন মোদী। যদিও বিরোধীরা বলেছিলেন, তা তো হবেই, পঙ্কেই তো বিকশিত হয় পদ্ম! কিন্তু বাংলায় পঞ্চায়েত ভোটের ক্ষেত্রে মোদীর সেই ফর্মুলা কাজে লাগল না। পঞ্চায়েত ভোটের ফলের পর তৃণমূলের কোনও কোনও নেতা এমনও বলছেন, ‘‘ওঁরা কাদা ছোড়ার চেষ্টা করেছিলেন, ইডি,সিবিআই অনেক কিছুই টেনে এনেছিলেন। কিন্তু সেই কাদায় পদ্ম ফোটেনি।’’

Advertisement

তবে কাদায় যে পদ্ম ফোটেনি, বরং বহাল তবিয়তে ঘাসফুলই মাথাচাড়া দিয়েছে, তার প্রমাণ রাজ্যে সর্বাধিক আলোচিত নিয়োগ মামলার জেলবন্দি কয়েকজন বর্তমান এবং বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতার পাড়ার ফল। নিয়োগ মামলায় এই মুহূর্তে জেলে রয়েছেন তৃণমূলের তিন বিধায়ক পার্থ চট্টোপাধ্যায়, মানিক ভট্টাচার্য এবং জীবনকৃষ্ণ সাহা। একই মামলায় জেলে রয়েছেন দুই বহিষ্কৃত তৃণমূল যুবনেতা শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কুন্তল ঘোষও। এর মধ্যে পার্থ শহরের বাসিন্দা। বেহালার বিধায়ক তিনি। তাঁর এলাকায় পঞ্চায়েত ভোট হয়নি। বাকি চার জনই জেলার নেতা। তাঁদের এলাকায় এবং দুই বিধায়কের বিধানসভা কেন্দ্রে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে। আর সেই পঞ্চায়েত ভোটের ফল বিচার করে দেখা যাচ্ছে, একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে, নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত নেতাদের এলাকাতে ঝোড়ো জয় পেয়েছে তৃণমূল।

মানিকের কথাই ধরা যাক। নিয়োগ দুর্নীতিতে অন্যতম অভিযুক্ত নদিয়ার পলাশিপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক মানিক। যে টেট দুর্নীতির অভিযোগে শুরু থেকেই পথে নেমেছিলেন টেট পরীক্ষার্থীরা, সেই টেট-এর নিয়ন্ত্রক সংস্থার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন মানিক। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতিকে নিয়োগ দুর্নীতিতে গ্রেফতার করা হলেও দল তাঁর বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ করেনি। সেই মানিকের পাড়ায় জিতেছে তৃণমূল। আবার হেরেছেও।

Advertisement

মানিকের বিধানসভা এলাকা পলাশিপাড়া। তবে তিনি থাকেন কালীগঞ্জে। তৃণমূল পলাশিপাড়ায় ভাল ফল করতে পারেনি। যদিও মানিকের কালীগঞ্জে বড় ব্যবধানে জিতেছে। নদিয়ার তেহট্ট ২ ব্লকের মধ্য়ে পড়ে পলাশিপাড়া বিধানসভা কেন্দ্র। এই ব্লকে রয়েছে সাতটা গ্রাম পঞ্চায়েত। এর মধ্যে তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত— গোপীনাথপুর, পলসন্দা ২ এবং বার্মিয়ায় জিতেছে তৃণমূল। বাকি চারটির মধ্যে পলাশিপাড়ার ফল ত্রিশঙ্কু। সাহেবনগর জিতেছে বিজেপি জোট। ঘাসপুকুরিয়ায় বিজেপি এবং পলসন্দা ১ পঞ্চায়েতে জিতেছে বাম এবং নির্দল। তবে গ্রাম পঞ্চায়েতের আসনে ভাল না করলেও পলাশিপাড়ার জেলা পরিষদের তিনটি আসনেই জয়ী হয়েছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতির ২১টা আসনের মধ্যেও ১৫টিতে তৃণমূলই জিতেছে। মানিকের বাড়ির কাছের কালীগঞ্জে অবশ্য মোট ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ৩০৩টি আসনের মধ্যে ১৫৬টিতে জয়ী হয়েছে তৃণমূল। দুর্নীতির প্রভাব যদি পড়েই থাকে তবে মানিকের বিধানসভা ক্ষেত্রের গ্রাম পঞ্চায়েতে পড়ল আর তাঁর নিজের পাড়ায় পড়ল না— এমন হতে পারে না বলেই মনে করছেন তৃণমূল নেতারা। পলাশিপাড়ায় খারাপ ফল নিয়ে নদিয়া জেলা তৃণমূলের মুখপাত্র বাণীকুমার রায় বলেন, ‘‘মানিক ভট্টাচার্যের জন্য পলাশিপাড়ায় খারাপ ফল হয়েছে, এটা আমি বলতে পারব না। হতে পারে নিজেদের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝির জন্য এ রকম ফল হয়েছে।’’ তবে কি পলাশিপাড়ায় গোষ্ঠীকোন্দল ছিল? জবাবে বাণীকুমার বলেন, ‘‘আমি তা বলছি না। তবে মানিক ভট্টাচার্য এই ফলের কারণ নন। তা যদি হত, তবে আরও যাঁরা গ্রেফতার হয়েছেন, তাঁদের এলাকাতেও খারাপ ফল হতে পারত।’’

এই বক্তব্যে যে ভুল নেই তার প্রমাণ মিলেছে বাকি তিন নেতার এলাকায় পঞ্চায়েত ভোটের ফলে। মুর্শিদাবাদের বড়ঞার বিধায়ক জীবনকৃষ্ণের নামও উঠেছিল নিয়োগ মামলায়। চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নামে তিনিও টাকা তুলেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছিল। সিবিআই তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালাতে গেলে নিজের ফোনটি ছুড়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন বিধায়ক। সেই ফোন থেকে গূঢ় তথ্য উদ্ধার করতে হিমশিম খেতে হয়েছিল সিবিআইকে। বিধায়কের বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছিল বহু প্রামাণ্য নথিপত্র। সেই জীবনকৃষ্ণ এখন জেলবন্দি। তাঁর এলাকা বড়ঞা ব্লকে ৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত। আসন সংখ্যা ২৩৪টি। এখানেও ১১০টিতে জিতেছে তৃণমূল। জেলা পরিষদের ৩টে আসনেও তৃণমূলেরই দখলে। পঞ্চায়েত সমিতিতেও ৩৮টি আসনের মধ্যে ২১টি জিতেছে তৃণমূল। অর্থাৎ দলের বিধায়কের নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ার প্রভাব তৃণমূলের ভোট ব্যাঙ্কে সে ভাবে পড়েনি।

নিয়োগ মামলায় তৃণমূল থেকে অধুনা বহিষ্কৃত হুগলির দুই যুব নেতার কীর্তির এখনও তল পায়নি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তৃণমূলের শীর্ষ স্তরের নেতা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সর্বত্রই জাল বিস্তার করেছিলেন হুগলির বলাগড়ের বাসিন্দা শান্তনু এবং কুন্তল। দু’জনেই বলাগড়ের শ্রীপুর পঞ্চায়েতের বাসিন্দা। তবে দু’জনের ভোট দানের বুথ আলাদা। জেল বন্দি ওই দুই বহিষ্কৃত যুব তৃণমূল নেতার বুথেও বড় ব্যবধানে জিতেছে তৃণমূল।

বলাগড় ব্লকের ১৩টা গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১৩টাই পেয়েছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত সমিতিতে আসন ছিল ৩৯টি। তার মধ্যে ৩৭টি তৃণমূলের দখলে (একটি বিজেপি এবং একটি সিপিএম জিতেছে)। জেলা পরিষদেরও তিনটি আসন পেয়েছে তৃণমূল। তৃণমূল সূত্রে খবর, শান্তনুর বুথের গ্রাম সভার তৃণমূলের প্রার্থী জয়ের পরে শান্তনুর নামে জয়ধ্বনিও দিয়েছিলেন। আবেগ ধরে রাখতে না পেরে যখন তিনি ‘শান্তনু দা জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিচ্ছেন তখন পাশে দাঁড়ানো অন্য তৃণমূল কর্মীরা তাঁকে সতর্ক করেন। তার পর অবশ্য দ্বিতীয়বার আর সেই স্লোগান মুখে আনেননি তিনি।

হুগলির বলাগড়ে তৃণমূলের জয় নিয়ে দলের হুগলির সাংগঠনিক জেলা সভাপতি তথা চাঁপদানির বিধায়ক অরিন্দম গুঁইনকে যোগযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘মানুষ উন্নয়নের পক্ষে ভোট দিয়েছে। বিরোধীরা যে অপপ্রচার করেছিল, তা মানুষ গ্রহণ করেননি। মানুষ দেখেছেন রাস্তা, জল, লক্ষ্মীর ভান্ডার, স্বাস্থ্যসাথী। গোটা দেশ জেনে গিয়েছে, অ-বিজেপি রাজ্যগুলিতে কী ভাবে বিজেপি ভয় দেখানোর জন্য ইডি-সিবিআইকে লেলিয়ে দিচ্ছে । মানুষ ওদের খেলা ধরে ফেলেছে।’’

যদিও বিরোধীদের বক্তব্য, ‘‘এই ফল আসল নয়।’’ সিপিএমের হুগলি জেলার সম্পাদক তথা রাজ্য সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য দেবব্রত ঘোষ বলেন, ‘‘দুর্নীতির প্রভাব অবশ্যই পড়েছে। সেই কারণেই হুগলিতে সিপিএম একক ভাবে গ্রাম পঞ্চায়েতে ২০০-র বেশি আসন জিতেছে। যে ফল দেখা যাচ্ছে, তা আসল নয়। কারণ তৃণমূল ভোট চুরি করেছে। আমরা হাই কোর্টেও গিয়েছি এ ব্যাপারে।’’ যদিও ভোটের দিন বলাগড় ব্লকে ছাপ্পা হচ্ছে বা রিগিং হচ্ছে বলে কোনও অভিযোগ সিপিএম করেনি। বরং আনন্দবাজার অনলাইনকে বলাগড়ের নির্বাচনের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক তরুণ নেতা জানিয়েছিলেন, খুব ভাল ভোট হচ্ছে। বুধবার দেবব্রতও বলাগড় নিয়ে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে চাননি।

বিজেপি জেলবন্দি নেতাদের এলাকায় তৃণমূলের জয় প্রসঙ্গে বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘‘এক দল লোক টাকা লুট করে, লোকের চাকরি বিক্রি করে, জেলে গিয়েছেন। সেটা গোটা রাজ্যের মানুষ দেখেছেন। এ বার তাদের দল ভোট লুট করেছে, এখানে ভোটের নামে প্রহসন হয়েছে। ভোটগণনাতেও কারচুপি হয়েছে। সুতরাং কোথায় তৃণমূল ভাল ফল করেছে মানুষ সে সব নিয়ে ভাবছে না। সাধারণ মানুষ তৃণমূলকে ঘৃণার চোখেই দেখছে। নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ ভোট হলেই তা স্পষ্ট হয়ে যেত।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement