West Bengal Panchayat Election 2023

জঙ্গলমহলে ধাক্কা পদ্মের, শাল-কেন্দুর সব জেলাই সবুজে সবুজ, সন্ত্রাসের নালিশই যুক্তি গেরুয়ার

বিজেপি বলছে, গত কয়েক বছরে তাদের তরফে কিছুই বদলায়নি। বরং জঙ্গলমহলের এক জেলার সাংসদকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করা হয়েছে। দেশের রাষ্ট্রপতি পদে আনা হয়েছে আদিবাসী সম্প্রদায়েরই এক প্রতিনিধিকে।

Advertisement

ঐন্দ্রিলা বসু সিংহ

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০২৩ ১৯:৪০
Share:

প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কেন মত বদলাল জঙ্গলমহল? গ্রাফিক— সনৎ সিংহ।

পঞ্চায়েত ভোটের আগে ‘নবজোয়ার’ কর্মসূচিতে জঙ্গলমহলে গিয়েছিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। শালবনি যাওয়ার পথে তাঁর কনভয়ের গাড়িতে ভাঙচুর চালান এলাকার কিছু বিক্ষোভকারী। অভিযোগের তির উঠেছিল আদিবাসী সম্প্রদায়ের কুড়মি জনজাতিদের দিকে। যদিও অভিষেক বলছিলেন, কুড়মিদের ভিড়ে সেদিন তিনি ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন। দু’মাস পর সেই জঙ্গলমহলে পঞ্চায়েত ভোটের ফল বলছে ‘রাম’ ধ্বনি ফিকে হয়েছে। জঙ্গলে জমি বেড়েছে ঘাসফুলের।

Advertisement

২০১৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে প্রথম জঙ্গলমহলে মাটি পেয়েছিল পদ্মশিবির। তৃণমূলকে হারিয়ে জঙ্গলমহলের পঞ্চায়েতের দখল পায় বিজেপি। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটের গণনার যে ধারা, তাতে দেখা যাচ্ছে, জঙ্গলমহলের পঞ্চায়েতের অধিকাংশ আসনেই এগিয়ে তৃণমূল। বুধবার বিকেল পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী পুরুলিয়ার ২৪৭৬টি আসনের মধ্যে প্রায় ১৪৯৬ আসনে হয় জয়ী নয়তো এগিয়ে তৃণমূল। বিজেপি জিতেছে মাত্রই ৪৩৩টি আসনে। ঝাড়গ্রামে ১০০৭টি আসনের মধ্যে ৬৯২টিতে জিতেছে তৃণমূল। বাঁকুড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরেও এগিয়ে রয়েছে তৃণমূলই। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কেন মত বদলাল জঙ্গলমহল? গত পঞ্চায়েত ভোটে তৃণমূলকে ছেড়ে বিজেপির হাত ধরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাংলার যে আদিবাসী সম্প্রদায়, তারা পঞ্চায়েত ভোটে আবার পদ্ম ছেড়ে ঘাসফুল হাতে তুলে নিলেন কেন?

গত বারের পঞ্চায়েতে জঙ্গলমহলে যে সাফল্য পেয়েছিল বিজেপি, তা ধরে রাখতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি তারা। বিধানসভার প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এসেছিলেন জঙ্গলমহলে প্রচারে। শুধু জঙ্গলমহলের মানুষের বক্তব্য শোনার জন্য উৎসর্গ করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর একটি ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠান। তাতে ফল মেলেনি, তা-ও নয়। বরং সাফল্য জারি ছিল। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেও জঙ্গলমহলে ভাল ফল করেছিল বিজেপি। বাংলার ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৮টির দখল নিয়েছিল পদ্মশিবির। তার মধ্যে ছিল জঙ্গলমহলের জেলাগুলির আসনও। রাজ্যের চারটি জেলা— ঝাড়গ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং পুরুলিয়ার ২৩টি ব্লক নিয়েই জঙ্গলমহল। গত লোকসভা ভোটে এর মধ্যে বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, মেদিনীপুর এবং পুরুলিয়া— চারটি লোকসভা আসনই তৃণমূলের হাত থেকে আসে বিজেপির হাতে। বিধানসভা কেন্দ্রের নিরিখে হিসাব মিলিয়ে দেখা গিয়েছিল, জঙ্গলমঙ্গলের অন্তর্গত ৪০টি বিধানসভার মধ্যে ৩০টিতেই ভোটের হারে তৃণমূলের থেকে এগিয়েছিল বিজেপি। এর পর আসে বিধানসভা ভোট। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে জঙ্গলমহলে ৪০টি বিধানসভার মধ্যে ১৬টির দখল নিয়েছিল বিজেপি। ২৪টি আসন পেয়ে তাদের টেক্কা দেয় তৃণমূল। কিন্তু বিজেপি সেই হারকে ‘ব্যর্থতা’ ভাবেনি। বরং তারা বলেছিল, জঙ্গলমহলে তারা ১৬টি আসন পেলেও ভোট শতাংশের হিসাবে তাদের হাতে এসেছে ৪৪ শতাংশ আদিবাসী ভোট। যা নেহাত কম নয়।

Advertisement

তা হলে ২০২১ থেকে ২০২৩—দু’ বছরে কী বদলাল?

বিজেপি বলছে, তাদের তরফে কিছুই বদলায়নি। বরং গত লোকসভার পর বাঁকুড়া থেকে জেতা বিজেপি সাংসদকে কেন্দ্রে মন্ত্রী করেছে তারা। দেশের শীর্ষপদে অর্থাৎ রাষ্ট্রপতির আসনে বসিয়েছে একজন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষকে। রাষ্ট্রপতি হিসাবে দ্রৌপদী মুর্মূকে প্রার্থী করায় বরং সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিছুটা চাপেই ফেলতে পেরেছিল তাঁরা। তার কারণও ছিল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৃণমূল-সহ বিরোধীদের প্রার্থী হয়েছিলেন তদানীন্তন তৃণমূল নেতা যশবন্ত সিন্‌হা। বিহারের কায়স্থ পরিবারের সন্তান যশবন্তের বিরুদ্ধে বিজেপির ‘তুরুপের তাস’ ছিলেন ওড়িশার বাসিন্দা তথা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মুখ দ্রৌপদী মুর্মূ । আদিবাসীদের অধিকার পাইয়ে দেওয়ার কথা বললেও মমতা সেই সময় দ্রৌপদীকে সমর্থন করতে পারেননি। কারণ, বিজেপি দ্রৌপদীর নাম ঘোষণা করার আগে তিনি-সহ বিরোধীরা যশবন্তের নাম দিয়ে দিয়েছিলেন। সেই আক্ষেপ প্রকাশ্যেই জানিয়েছিলেন মমতা। প্রতিবছর আদিবাসী দিবস পালন করা, আদিবাসীদের অনুষ্ঠানে ধামসা মাদলের তালে নাচে দুলে ওঠা মমতাকে সেই সময় ‘আদিবাসী বিরোধী’ বলেও মন্তব্য করেছিল বিজেপি। অথচ তার পরেও সেই মমতার তৃণমূলই গ্রামবাংলার ভোটে আদিবাসী সমর্থন পেল!

বিজেপি এর ব্যাখ্যায় বলেছে, ‘আদিবাসী ফ্যাক্টর’ নয়, মমতাকে দু’হাত তুলে ভোট দিয়েছেন জঙ্গলমহলের মহিলারা। প্রশংসা নয়, বিজেপির সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষের দাবি, হুমকির ভয়েই তাঁরা এ কাজ করেছেন। দিলীপের কথায়, ‘‘এ বার শুধু তৃণমূল নয়, সরকারি কর্মী এবং অফিসাররাও মহিলাদের ভয় দেখিয়ে বলেছেন, তৃণমূলকে ভোট না দিলে সরকারি প্রকল্পের টাকা বন্ধ হয়ে যাবে। লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে বিধবা ভাতা নিয়ে এই প্রচারের ফলে গ্রামীণ এবং পিছিয়ে থাকা শ্রেণির মহিলারা তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন।’’ একই সঙ্গে দিলীপের সংযোজন, ‘‘তবে সবচেয়ে বড় কারণ সন্ত্রাস। ব্যাপক হারে ছাপ্পা ভোট হয়েছে।’’ যদিও রাজ্যের পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার পর থেকে ভোট হওয়া পর্যন্ত এমনকি, গণনা চলাকালীনও যে সমস্ত এলাকা থেকে গন্ডগোলের খবর এসেছিল, তার পরিসংখ্যান বলছে, জঙ্গলমহল থেকে বিশেষ গোলমালের খবর আসেনি কখনও।

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী আবার বলেছেন, ‘‘বাক্স পাল্টেছে। কোনদিন সত্যি সামনে এলে সব জানতে পারবেন। বিভিন্ন জেলাশাসক, বিডিওদের দিয়ে বাক্স বদল করা হয়েছে। এই ফল আসল ফল নয়।’’ তবে বিজেপির ভোটের একটা অংশ অন্যত্র গিয়েছে বলেও মনে করছেন বিজেপির নেতা দিলীপও। তিনি বলেছেন, ‘‘বিজেপির ভোট কেটেছে সিপিএম। কুড়মি এবং মাহাতদের একটা অংশ আলাদা লড়েছে। তৃণমূলের সঙ্গে ওদের সেটিং ছিল। সব মিলিয়েই আমাদের ভোট কমেছে।’’

তবে বিরোধীরা যা-ই বলুক, তৃণমূল জয়ের জন্য মমতা এবং উন্নয়নের কথাই বলেছে। দলের বিধায়ক তাপস রায়ের বক্তব্য, ‘‘উন্নয়ন দেখেই সাধারণ মানুষ তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। জঙ্গলমহলের মানুষ বুঝতে পেরেছেন, কারা তাঁদের বন্ধু। তৃণমূল মা-মাটি-মানুষের দল। তারা বরাবর মাটির কাছের মানুষের সঙ্গেই থেকেছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement