গ্রাফিক— সনৎ সিংহ।
আরজি কর-কাণ্ডের তদন্তের জন্য সিবিআইয়ের উপরেই ভরসা করছেন আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা। কারণ তাঁদের আশঙ্কা, এ রাজ্যে সর্ষের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ভূত। এ ব্যাপারে বিভিন্ন প্রামাণ্য ঘটনার উল্লেখ করে আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা অভিযোগ করেছেন, ‘‘আড়ালে থেকে একটি ক্ষমতাশালী চক্র সক্রিয় হয়ে তদন্তে বাধা সৃষ্টি করছে, যাদের চাপের কাছে স্বাস্থ্য ভবনও অসহায়।’’
আন্দোলনকারীরা স্পষ্ট জানিয়েছেন, এই চক্রের জন্য আসল দোষীরা এখনও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই আরজি করকে আধা সেনাবাহিনী দিয়ে মুড়ে ফেলা হলেও সেখানকার চিকিৎসকেরা নিরাপদ বোধ করছেন না। আর তাই তাঁরা তাঁদের কর্মবিরতিও এখনই প্রত্যাহার করছেন না।
রবিবার একটি সাংবাদিক বৈঠক করে নিজেদের ওই বক্তব্য জানিয়েছেন আরজি করের আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের প্রতিনিধিরা। কেন তাঁরা কর্মবিরতি বন্ধ করছেন না, তার সপক্ষে কয়েকটি প্রমাণ এবং যুক্তি পেশ করেছেন তাঁরা। প্রথমেই তাঁরা ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে। পুলিশ কমিশনারের পদত্যাগের দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা।
কলকাতা পুলিশ ব্যর্থ: আরজি কর
আরজি করে হামলার ঘটনায় মূলত কলকাতা পুলিশকেই দোষী ঠাওরেছেন আন্দোলনকারীরা। তাঁরা বলেছেন, ‘‘এটা স্পষ্ট যে হামলাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল আন্দোলনকারী জুনিয়র চিকিৎসকদের ভয় দেখানো এবং তথ্যপ্রমাণ লোপাট করা! সিসি ক্যামেরায় আমরা স্পষ্ট দেখেছি, দুষ্কৃতীদের একটি দল জরুরি বিভাগের গেট দিয়ে ঢুকে একটি ফ্লোরে কোনও রকম ভাঙচুর না করে সেমিনার রুম খুঁজতে অন্য ফ্লোরগুলিতে ভাঙচুর চালায়। ওই সময়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা আমাদের কাছে যন্ত্রণাদায়ক। এক দিকে তারা নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। তার উপরে তারা অসংবেদনশীল এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার উপর গোটা দোষটা চাপিয়ে আসল দোষীদের আড়াল করেছে। আমাদের মতে কলকাতা পুলিশ সুবিচার পাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। ন্যায়বিচারকে বিলম্বিত করার পথে মূল ভূমিকা নিয়েছে।’’
সর্ষের মধ্যে ভূত!
আন্দোলনকারীদের মতে, দ্বিতীয় একটি শক্তিও ন্যায়বিচার পাওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। আন্দোলনকারী চিকিৎসকেরা বলছেন, ‘‘২১ তারিখ আমরা স্বাস্থ্য ভবনে বৈঠক করেছিলাম। জানতে চেয়েছিলাম, সন্দীপ ঘোষ-সহ বাকি কর্তৃপক্ষকে প্রশাসনিক ব্যর্থতার দায় নিয়ে কেন এখনও অপসারণ করা হচ্ছে না। তখন প্রশাসনিক জটিলতা ছাড়া আর কোনও সদুত্তর মেলেনি। তাতেই স্পষ্ট হয়ে যায় এঁদের বাঁচানোর পিছনে এক অশুভ দুষ্ট চক্র অতিমাত্রায় সক্রিয়। যাঁরা এত কিছুর পরেও সন্দীপ ঘোষ-সহ কর্তৃপক্ষকে আড়াল করতে ব্যস্ত এবং তাঁদের চাপের কাছে স্বাস্থ্য ভবনও কার্যত অসহায়।’’ উল্লেখ্য ওই বৈঠকের কয়েক ঘণ্টা পরে ছাত্রদের দাবি মেনে আরজি করের অধ্যক্ষ-সহ বক্ষরোগের বিভাগীয় প্রধানকে অন্যত্র বদলি করা হয়। কিন্তু আন্দোলনকারীদের প্রশ্ন, ‘‘যাঁর বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্ত শুরু হয়েছে সেই সন্দীপ ঘোষকে কেন সাসপেন্ড করা হল না? তাঁকে শুধু হাই কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সমস্ত অভিযোগে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার আগে পর্যন্ত স্বাস্থ্য ভবন কেন তাঁকে সাসপেন্ড করতে পারছে না? কে বা কারা তাদের বাধা দিচ্ছে?’’
দুষ্ট চক্র সব মেডিক্যাল কলেজেই!
আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, সন্দীপকে কেন সাসপেন্ড করা হল না, ওই প্রশ্নের উত্তর জটিল নয়। কারণ, তাঁদের কথায়। ‘‘গত কয়েক বছর ধরে আরজি করে যে ভয়ের রাজনীতি চালানো হয়েছে, সন্দীপের অনুগত একটা অংশ যে ভাবে আর্থিক এবং অন্যান্য দুর্নীতি করেছে, তাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য একটি দুষ্ট চক্র সক্রিয় ছিল। তারা শুধু আরজি কর নয়, বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজেই এখনও সক্রিয়। এরা অন্যায়ের প্রতিবাদ করলেই জুনিয়র ডাক্তারদের ফেল করানো এবং চিকিৎসকদের বদলি করানোর ভয় দেখায় এবং বদলি করে।’’ আন্দোলনকারীরা মনে করছে এই অংশটির সঙ্গে কলকাতা পুলিশ-সহ স্বাস্থ্য ভবনও জড়িত। তারাই আরজি কর-কাণ্ডে ন্যায় বিচার বিলম্বিত করছে।
স্বাস্থ্য পরিষেবা বেহাল নয়
একই সঙ্গে এ-ও জানিয়েছেন, তাঁরা কাজে যোগ না দেওয়ায় স্বাস্থ্য পরিষেবা বেহাল হয়ে পড়েছে বলে যে বক্তব্যের প্রচার করা হচ্ছে তা সত্য নয়। জুনিয়র ডাক্তারদের কথায়, ‘‘ইমার্জেন্সি-সহ সমস্ত বিভাগ চালু। সিনিয়র চিকিৎসকেরা বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছেন। আমরাও কাজে যোগদান করতে চাই। কিন্তু বিচার পাওয়ার প্রশ্নে যারা বাধা সৃষ্টি করছে, তারা যদি সক্রিয় থাকে, তবে নিরাপদ বোধ করব কী ভাবে? সিআইএসএফ দিয়ে আরজি করকে মুড়ে দিয়ে কী হবে যদি আসল অপরাধীদের আড়াল করার জন্য ভিতরেই কোনও চক্র সক্রিয় থাকে? এবং তাতে পুলিশি মদত থাকে।’’ তাঁরা জানিয়েছেন, আন্দোলন থামানোর জন্য স্বাস্থ্য ভবন সকলের চোখের আড়ালে বন্ধ ঘরে প্রতিনিধিদের ডেকে পাঠিয়ে সেটলমেন্টের ‘অপচেষ্টা’ করছে। কিন্তু তা তাঁরা মানবেন না। চিকিৎসকেরা বলেছেন, ‘‘যা আলোচনা করার তা প্রকাশ্যে করতে হবে।’’
চার দফা দাবি:
১। ৯ অগস্টের ঘটনায় জড়িত দোষীদের চিহ্নিত করা। এবং ওই ঘৃণ্য ঘটনার মোটিভ এখনও আমাদের কাছে অজানা। হয়তো দোষীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাই আমরা নিরাপদ নই। অতি দ্রুত দোষীদের সনাক্তকরণ এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
২। তথ্যপ্রমাণ লোপাটের ঘটনায় যে বা যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে জড়িত, তাদের প্রত্যেককে তদন্ত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে। স্বাস্থ্য ভবনের প্রত্যক্ষ মদতে যে দুষ্ট চক্র এতে সক্রিয় ছিল, তাদের আড়াল করা চলবে না। স্বাস্থ্য ভবনকে অবিলম্বে সন্দীপ ঘোষকে সাসপেন্ড করতে হবে।
৩। সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী কলকাতা পুলিশ-প্রশাসন এই ঘটনার তদন্তে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ। এই ব্যর্থতার দায় নিয়ে পুলিশ কমিশনারকে পদত্যাগ করতে হবে। প্রয়োজনে তাঁকেও বিচার ও তদন্তের আওতায় আনতে হবে।
৪। প্রতিটি কলেজে ভয়ের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। স্বচ্ছ ভাবে নির্বাচন করতে হবে। সমস্ত কলেজ এবং হাসপাতালে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সমস্ত কমিটিকে জুনিয়র ডাক্তার এবং মেডিক্যাল ছাত্রছাত্রীদের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করতে হবে। যাঁদের গণতান্ত্রিক ভাবে ভোটের মাধ্যমে বেছে নেওয়া হবে।
সোমবার গণ কনভেনশন
আরজি করের প্রতিবাদ মঞ্চে সংহতি সভার আয়োজন করা হচ্ছে। বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসবেন সংহতি জানাতে। আগামী কাল বিকেল সাড়ে ৪টেয় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে একটি গণ কনভেনশনের ডাক দেওয়া হয়েছে। আরজি করে যে হেতু আধাসামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা রয়েছে, তাই অনুমতি নিয়ে সমস্যা হচ্ছিল বলেই আরজি করে হচ্ছে না।