সংগ্রহশালার কাজ এগিয়েছে সামান্যই। নিজস্ব চিত্র।
স্থাননামেই রয়েছে ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতিবাহী পূর্ব মেদিনীপুরের পিছাবনিতে শহিদ স্তম্ভও গড়া হয়েছিল একসময়। তবে অনাদরেই পড়ে রয়েছে তা। কয়েক বছর আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ‘লবণ সত্যাগ্রহ স্মারক মিউজ়িয়াম’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা-ও হয়নি।
১৯৩০ সাল। গান্ধীজির ডাকে লবণ সত্যাগ্রহের ঢেউ সারা দেশে আছড়ে পড়েছে। কাঁথি-রামনগরের সীমানায় খালপাড়ে দাঁড়িয়ে সে দিন ইংরেজদের সামনে গ্রামবাসী গর্জে উঠেছিলেন, ‘আমরা পিছাবনি।’ গোটা তল্লাট আজও পরিচিত পিছাবনি বলে। খালের নামও পিছাবনি খাল। ১৯৩০-এর ৬ এপ্রিল এলাকার চিকিৎসক সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে লবণ সত্যাগ্রহীরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়েছিলেন। তৎকালীন ইংরেজ জেলাশাসক জেমস পেডি, জেলা আবগারি বিভাগের প্রধান হসকিম্স, জেলা পুলিশ আধিকারিক কিড ও কাঁথির তৎকালীন এসডিপিও সামসুদ্দোহা লবণ সত্যাগ্রহীদের আন্দোলন তুলে নিতে বললে প্রতিরোধ হয়। ১১ এপ্রিল ইংরেজ পুলিশ সুরেশচন্দ্র ও ঝড়েশ্বর মাঝিকে গ্রেফতার করে। প্রতিবাদে ঝড়েশ্বরের মা পদ্মাবতী আন্দোলনে যোগ দেন। এখানে গড়ে উঠেছিল লবণ সত্যাগ্রহ কেন্দ্রও। বিয়াল্লিশের ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলনে’ও পিছাবনির কাছে মহিষাগোটে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ৬ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী। জখম ২৪ জন। সেই গৌরবগাথা এখন অনেকটাই ম্লান। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে ইতিহাস রক্ষার তেমন উদ্যোগও নেই। পিছাবনি বাজারের ভিতরে স্থানীয় হাইস্কুলের কাছে লবণ সত্যাগ্রহ কেন্দ্র স্মারক স্তম্ভটা বছরভরই অনাদরে পড়ে থাকে। বিশেষ দিনে একটু ফুল-মালা জোটে শুধু। পিছাবনি খালের উপর বাম আমলে তৈরি লবণ সত্যাগ্রহ স্মারক সেতুর নামমাহাত্ম্যও অনেকেরই অজানা। এমনকি স্মারক স্তম্ভের কাছে আড্ডা জমানো পিছাবনি হাইস্কুলের পড়ুয়ারা বলে, ‘‘এ সব জানি না।’’
এলাকার স্মৃতি রক্ষার্থেই তাই সংগ্রহশালা গড়ার উদ্যোগ হয়। ২০১৯ সালে পূর্ব মেদিনীপুর সফরে এসে খোদ মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, পিছাবনির লবণ সত্যাগ্রহকে স্মরণীয় করে রাখতে মিউজ়িয়াম গড়ে তোলা হবে। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সংগ্রহশালায় লবণ সত্যাগ্রহের সঙ্গে জড়িত স্থানীয়দের ব্যবহৃত নানা সরঞ্জাম, জেলার বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতিচিহ্ন ও মহাত্মা গান্ধীর কিছু ব্যবহৃত জিনিস রাখা হবে। কিন্তু তিন বছরেও কাজ প্রায় কিছুই এগোয়নি। কাঁথি থেকে দিঘাগামী ১১৬ বি জাতীয় সড়কের বাঁ দিকে সেতুতে ওঠার আগে একটা কাঠামোর কিছুটা অংশ শুধু তৈরি হয়েছে। কাঁথি ১-এর বিডিও তুহিনকান্তি ঘোষ বলেন, ‘‘পুরো কাজটি পূর্ত দফতর দেখাশোনা করছে। নির্মাণ শেষ হলে সংগ্রহশালার বাকি কাজ শুরু হবে।’’
পিছাবনির ইতিহাস রক্ষায় অনাদর বিদ্বজ্জনেদের ভাবাচ্ছে। স্থানীয় ইতিহাসের গবেষক তথা মুগবেড়িয়া কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ হরিপদ মাইতির আক্ষেপ, ‘‘বর্তমান প্রজন্ম আমাদের অতীত ভুলে যাচ্ছে। ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এর দায় তো আমাদেরই।’’ দিঘা ডি এল হাইস্কুলের শিক্ষক নন্দগোপাল পাত্রও বলছিলেন, ‘‘এখন তো স্বাধীনতা দিবস মানে একটা ছুটির দিন, বড়জোর মোটরবাইকে বা গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো। পিছাবনির মতো ঐতিহাসিক স্থানে সংগ্রহশালা হলে ছেলেমেয়েগুলো অন্তত নিজেদের অতীত গৌরব জানতে পারবে।’’