—প্রতীকী ছবি।
১৯৮৩ সাল। দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি গ্রামের ১৬ জন বাসিন্দার ত্বকে বিশেষ ধরনের সংক্রমণ ধরা পড়ে ওই বছর। বাসিন্দারা বুঝতে না পারলেও সেই তথ্য প্রকাশ্যে আসতেই সরকারি-বেসরকারি স্তরে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল। আর আর্সেনিকের সেই সংক্রমণ পাল্টে দিল কলকাতা-সহ এ রাজ্যের ভূগর্ভস্থ জলের ইতিহাস।
কারণ, ১৯৮৩ সালে ১৬ জন বাসিন্দার সংক্রমণের খবর প্রকাশ্যে আসার মাধ্যমে রাজ্যে যে আর্সেনিক-গ্রাস শুরু হয়েছিল, কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রকের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২০ সালের শুরুতে সেই গ্রাসের আওতায় রয়েছেন ৪৪ লক্ষ ৫০ হাজার ৮৮৯ জন! এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘অর্থাৎ ধরে নেওয়া যেতে পারে যে গত ৩৭ বছরে ৪৪ লক্ষ ৫০ হাজার ৮৭৩ জন নাগরিক আর্সেনিক আক্রান্ত হয়েছেন। প্রতি বছরে আক্রান্ত হয়েছেন গড়ে প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ!’’
অবশ্য পরিস্থিতি যে গুরুতর হতে চলেছে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়’-এর সমীক্ষা সে সময়েই ইঙ্গিত দিয়েছিল। ওই সমীক্ষা অনুযায়ী, আর্সেনিকোসিস-এর ঘটনা প্রথম প্রকাশ্যে আসার পাঁচ বছর পরে, অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে রাজ্যের ন’টি জেলার ৩৪১৭টি গ্রামের ১০৭টি ব্লকের জলেই আর্সেনিক মিলেছিল।
আরও পড়ুন: কোভিড-পরবর্তী চিকিৎসায় ক্লিনিক মেডিক্যালেও
‘স্কুল অব এনভায়রনমেন্টাল স্টাডিজ়’-এর সংশ্লিষ্ট সমীক্ষাকারী অধ্যাপক-গবেষক তড়িৎ রায়চৌধুরী জানাচ্ছেন, জলে আর্সেনিকের নির্ধারিত মাত্রা থাকার কথা প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম। সেখানে রাজ্যের একাধিক জেলায় তার মাত্রা কোথাও ৩৭০, কোথাও আবার ২৭০ গুণ বেশি! তা ছাড়া নির্ধারিত মাত্রার ৬০, ৭০ গুণ বেশি মাত্রার উপস্থিতি তো আকছার মেলে। তড়িৎবাবুর কথায়, ‘‘ফলে জল জীবন হলেও তাতে বহমান বিষ, আর্সেনিকের কারণে বিপন্ন লক্ষ-লক্ষ মানুষের জীবন!’’ সেই আশির দশক থেকেই ধীরে ধীরে দুই ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বর্ধমান থেকেও আর্সেনিক আক্রান্তের খবর আসা শুরু হয়। ২০০১ সালের মধ্যে দেখা যায়, জলে বহমান বিষ রাজ্যের আটটি জেলার ২০৬৫টি গ্রামের ১৫টি ব্লকে ছড়িয়ে পড়েছে। আর রাজ্যের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ এই আর্সেনিকের কবলে।
২০১৫ সালে জাতীয় পরিবেশ আদালত আর্সেনিকপ্রবণ অঞ্চলের সমীক্ষা করে ভূগর্ভস্থ জলের ম্যাপ তৈরির জন্য রাজ্যকে নির্দেশ দেয়। যে সমস্ত টিউবওয়েলের জলে আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে, তা জরুরি ভিত্তিতে ‘সিল’ করার নির্দেশ যায়। একই সঙ্গে ওই সব আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। এর মধ্যেই ‘সেন্ট্রাল গ্রাউন্ড ওয়াটার বোর্ড, ইস্টার্ন রিজিয়ন’-এর একটি রিপোর্টে দেখা যায়, রাজ্যের আটটি জেলার ৮৩টি ব্লকের পানীয় জলে আর্সেনিকের মাত্রা নির্ধারিত মাত্রার (প্রতি লিটারে ০.০১ মিলিগ্রাম) থেকে অনেক বেশি।
আরও পড়ুন: সব স্বাভাবিক হলেও বিমানে নিষেধাজ্ঞা কেন, বাড়ছে ক্ষোভ
পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে দেখে আর্সেনিক সমস্যার সুরাহার জন্য পরিবেশ আদালত বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরি করে। যদিও এক বিশেষজ্ঞের কথায়, ‘‘কমিটি হলেও কাজের কাজ হল না। কারণ, আর্সেনিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জল প্রকল্প রূপায়ণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত অর্থের সমস্যা হচ্ছে বলে রাজ্য সরকারের তরফে দাবি করা হয়।’’ যদিও রাজ্যের সে দাবি উড়িয়ে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন মন্ত্রক ২০১৭ সালে হলফনামা দিয়ে পরিবেশ আদালতকে জানাল, শহুরে এলাকায় সংশ্লিষ্ট প্রকল্প রূপায়ণের জন্য রাজ্যের দাবি মতো অর্থ বরাদ্দ করে দেওয়া হয়েছে। নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের এক কর্তার কথায়, ‘‘আর্সেনিক সংক্রমণ রুখতেও দফতরের বাজেটে নির্দিষ্ট বরাদ্দের কথা বলা হয়েছিল।’’
তার পরেও পরিস্থিতির তেমন উন্নতি না হওয়ায় পরিবেশ আদালত ২০১৭ সালে আরও একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি তৈরির নির্দেশ দিল। ২০১৮ সালে নতুন কমিটির রিপোর্ট থেকে জানা গেল, উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা ও তেঘরিয়া ব্লকে আর্সেনিকোসিস চিকিৎসার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাপ্তাহিক ‘আর্সেনিক ক্লিনিক’ চালু করতে হয়েছে। কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘চাঁদপাড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা করানো ৬৫ জন আর্সেনিক আক্রান্তের রিপোর্ট স্বাস্থ্য দফতরের মাধ্যমে কমিটির কাছে এসেছিল। তাতে অবশ্য নতুন আক্রান্তের খবর তেমন ছিল না।’’ যদিও সেই দাবি উড়িয়ে পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘উত্তর ২৪ পরগনার ৫৫.২৫ শতাংশ বাড়ি এখনও আর্সেনিকপ্রবণ!’’
তা হলে এর সমাধান কোথায়?
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে যে তাঁরা কী জল খাচ্ছেন। পরিবেশ আদালত গঠিত দ্বিতীয় বিশেষজ্ঞ কমিটির সদস্য তথা ‘অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অব হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্থ’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা, অধ্যাপক অরুণাভ মজুমদারের কথায়, ‘‘কারণ, এই টিউবওয়েলের জলে আর্সেনিক রয়েছে জানলে তা কেউ পান করবেন না। সঙ্গে তাঁকে এটাও জানাতে হবে, কোন টিউবওয়েলের জল আর্সেনিকমুক্ত। কী জল খাচ্ছি, তা জানলেই বিষ-বৃত্ত থামানো যাবে!’’