‘পুলিশ-ফ্রেন্ড’ নিয়ে বিতর্ক, বিরক্ত কমিশনারও

নিখোঁজ তরুণী সঙ্গীতা কুণ্ডুর নিয়োগকারী সংস্থার মালিক পরিমল সরকারকে পুলিশের অনেকেই ‘বন্ধু’ হিসেবে দেখেন বলেই দুমাসে তদন্ত এতটুকুও এগোয়নি বলে অভিযোগ করছেন বাড়ির লোকজন ও পড়শিদের অনেকেই।

Advertisement

কিশোর সাহা ও সৌমিত্র কুণ্ডু

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০১৬ ০১:৩৮
Share:

সঙ্গীতা কুণ্ডু যে সংস্থায় কাজ করতেন, তার মালিক পরিমল সরকারের একটি সংস্থার উদ্বোধনে সিপি। ফেসবুকে থাকা এই ছবি নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।

নিখোঁজ তরুণী সঙ্গীতা কুণ্ডুর নিয়োগকারী সংস্থার মালিক পরিমল সরকারকে পুলিশের অনেকেই ‘বন্ধু’ হিসেবে দেখেন বলেই দুমাসে তদন্ত এতটুকুও এগোয়নি বলে অভিযোগ করছেন বাড়ির লোকজন ও পড়শিদের অনেকেই। বুধবার সঙ্গীতার মা অঞ্জলিদেবী ও দাদা শম্ভুবাবু একযোগে অভিযোগ করেছেন, ‘‘একাধিক অফিসার ঘনিষ্ঠ হওয়ায় ‘পুলিশ-ফ্রেন্ড’ বলে পুলিশের অন্দরেই পরিচিতি রয়েছে পরিমলবাবুর। তাই হয়তো সব কিছু কিছুটা এগিয়ে ফের থমকে যাচ্ছে।’’ গত ১৭ অগস্ট সঙ্গীতা নিখোঁজ হন। তাঁর সংস্থার তরফে পরিমলবাবু ২৬ অগস্ট মিসিং ডায়েরি করেন। ৫ সেপ্টেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগ আনে নিখোঁজের পরিবার। তা নিয়ে অপহরণের মামলা রুজু হয়েছে। কিন্তু, এখনও তরুণীর হদিশ মেলেনি।

Advertisement

তবে পরিমলবাবু অবশ্য প্রভাব খাটানোর বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে আগেই দাবি করেছেন। তাঁর কথা অনুযায়ী, জিম ও শরীরচর্চার সূত্রেই তাঁর নানা মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হয়। কারণ, অতীতে তিনি একাধিকবার দেহশ্রী প্রতিযোগিতায় ‘মিস্টার নর্থ বেঙ্গল’ শিরোপা পেয়েছেন। রাজ্য শুধু নয়, বিহারেও দেহশ্রী প্রতিযোগিতায় অনেক শিরোপা রয়েছে পরিমলবাবুর ঝুলিতে। সেই সুবাদেও নেতা-মন্ত্রী-আমলাদের অনেকেই তাঁকে চেনেন বলে পরিমলবাবু নিজেই জানিয়েছেন। তাঁর যুক্তি অনুযায়ী, ‘‘আমার সংস্থার কর্মী নিখোঁজ হওয়ায় আমিও কম উদ্বেগে নেই। তদন্তে সব রকম সহযোগিতা করছি। আমিও চাই তাড়াতাড়ি সঙ্গীতার হদিস মিলুক। তা হলেই সব বিতর্ক, মিথ্যে অভিযোগের অবসান হবে।’’

ঘটনা হল, যে দিন নিখোঁজ তরুণীর বাড়ির লোকজন পরিমলবাবুর বিরুদ্ধে ভক্তিনগর থানায় অপহরণের অভিযোগ করেছেন, সে দিনই ওই এলাকাতেই অভিযুক্তের আরেকটি জিমের উদ্বোধনের ফিতে কেটেছেন শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার চেলিং সিমিক লেপচা। ওই ছবি নিজের ও সংস্থার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করার পরে পুলিশের সাধারণ অফিসারদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিবার ও পড়শিদের অনেকেই। এমনকী, যে শো-রুমের উদ্বোধন করেছেন সিপি, সেটির ট্রেড লাইসেন্স নেই বলেও পড়শিরা জেনেছেন। শিলিগুড়ির মেয়র অশোক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ওই নতুন শো রুম যে নামে উদ্বোধন হয়েছে তার ট্রেড লাইসেন্স নেই। মেয়র পারিষদ কমল অগ্রবালকে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’’

Advertisement

একে তো ভক্তিনগর থানার অফিসারদের একাংশের বিরুদ্ধে গোড়া থেকেই অভিযোগ। তার উপরে জিম উদ্বোধন, ‘পুলিশ-ফ্রেন্ড’ নিয়ে বিতর্ক জানা বাঁধায় বিরক্ত পুলিশ কমিশনারও। সিপি বলেন, ‘‘একটি জিমের উদ্বোধন শুনে রাজি হয়েছিলাম। আমাকে বলা হয়েছিল প্রতিষ্ঠানের সব কিছুই যথাযথ রয়েছে। এখন অনেক অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। তাতে কোনও পক্ষপাতমূলক আচরণ হবে না বলে হলফ করে বলতে পারি। তদন্ত প্রভাবিত হওয়ার প্রশ্ন নেই।’’

কমিশনারেট সূত্রের খবর, গোটা ঘটনায় কয়েকজনের ভূমিকায় সিপি ঘনিষ্ঠ মহলে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সূত্রের খবর, কেন ভাল করে খোঁজখবর না করে তাঁকে উদ্বোধনের জন্য অনুরোধ করানো হয়েছিল সেই প্রশ্নেও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তিনি। কমিশনারেটের এক অফিসার একান্তে জানান, তাঁদেরই এক সহকর্মী ওই জিমের কর্ণধারকে ‘পুলিশ ফ্রেন্ড’ বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। কমিশনারেট অফিসে একটি নতুন জিম তৈরির কাজ চলছে, তাতেও ‘ইন্সট্রাকটর’ পাঠানো সহ নানা পরামর্শ পরিমলবাবু দেবেন বলে সেই অফিসারদের অনেকে দাবি করেছিলেন।

শিলিগুড়ি পুরসভাসূত্রের খবর, পরিমলবাবুর অন্তত ৩টি মাল্টিজিম এবং জিমের সামগ্রী বিক্রির ৩টি শোরুম রয়েছে। অধিকাংশের ট্রেড লাইসেন্স পুরসভার নথিতে মেলেনি বলে পুরসভার একটি সূত্রের দাবি। সেবক রোড়ে তাঁর দুটি শোরুমের একটিরও ট্রেড লাইসেন্স নেই বলে পুর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। শিলিগুড়ি পুরসভার মেয়র পারিষদ কমল অগ্রবাল বলেন, ‘‘যে সংস্থার নামে ব্যবসা নথিভুক্ত রয়েছে সেই নামেই দোকান হবে। কিন্তু ওই সংস্থার বিজ্ঞাপনে ও সাইনবোর্ডে যে সব নাম দেখা যাচ্ছে, তার সব কটির ট্রেড লাইসেন্স আমাদের নথিতে মেলেনি।’’

(সহ প্রতিবেদন: কৌশিক চৌধুরী, অনির্বাণ রায়)

পুলিশের ভূমিকা কিছু প্রশ্ন পরিবারের

১৭ অগস্ট রাত ৯ টায় সঙ্গীতাকে শেষ দেখেছেন পরিমল সরকার। ৮ দিন অপেক্ষার পরে ২৬ অগস্ট পরিমলবাবু বাড়ির লোকদের না নিয়ে একাই মিসিং ডায়েরি করতে গেলেও পুলিশের সন্দেহ হয়নি কেন?

ভক্তিনগর থানার কেউ সঙ্গীতার বাড়িতে যাননি কেন?

সঙ্গীতার বাড়ির লোকজন ৪ সেপ্টেম্বর ভক্তিনগর থানায় গেলে দু’জন অফিসার ‘এফআইআরে পরিমলের নাম দেওয়া যাবে না’ বলে শর্ত দিয়েছিলেন, এণন অভিযোগ উঠেছে।

৫ সেপ্টেম্বর সঙ্গীতার দাদা যে ক্লাবের সদস্য, সেখানকার লোকজন ক্ষোভ প্রকাশ করলে ওই এফআইআর নেওয়া হয়। পরিমলবাবুর বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগে মামলা রুজু হয়। সে দিনই সন্ধ্যায় শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার চেলিং সিমিক লেপচাকে দিয়ে নিজের একটি জিমের উদ্বোধন করান পরিমলবাবু। সেই ছবি পরিমলবাবুর নিজের ও তাঁর সংস্থার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন। যাঁর বিরুদ্ধে অপহরণের অভিযোগে থানা মামলা করছে, সেই তিনিই সিপি-র পাশে দাঁড়িয়ে সেদিনই এমন ছবি সোসাল নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে দিলে, তার কী কী অর্থ হতে পারে।

কিছু পুলিশ অফিসার বারেবারেই বলছেন, সঙ্গীতা ফিরে আসতে পারে। কে, কেন এমন ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তা জানানো হচ্ছে না কেন?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement