আবাস প্রকল্পের কাজ যাচাই কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলের। ফাইল চিত্র।
রাজ্যের আবাস প্রকল্প নিয়ে কেন্দ্রের তরফ থেকে যে অভিযোগ নাগাড়ে তোলা হচ্ছিল, কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক দলের ঘুরে যাওয়া অধিকাংশ জেলায় তার প্রমাণ মিলেছে বলে লিখিত ভাবে রাজ্যকে জানিয়ে দিল গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক।
শুধু তা-ই নয়, রাজ্যের মুখ্যসচিবকে লেখা চিঠিতে এই গরমিলের সঙ্গে যুক্তদের বিরুদ্ধে এফআইআর করার সুপারিশ করেছে মোদী সরকারের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। গরমিলের সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করে তার রিপোর্ট দ্রুত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক সূত্রের অনুমান, শীঘ্রই আরও কয়েকটি জেলায় প্রকল্পের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আসতে পারে কেন্দ্রীয় দল। সামনেই পঞ্চায়েত ভোট। তার আগে এই রিপোর্ট যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনই তাতে কার্যত খানিকটা অস্বস্তিতে রাজ্য।
প্রশাসনের শীর্ষ মহলের অবশ্য বক্তব্য, গরিব মানুষ এ ধরনের প্রকল্পের উপভোক্তা। করের টাকায় প্রকল্পের খরচ চলে। ফলে তাঁদের বিপদে না ফেলে কাজ শুরু করতে দিলে বরং তা মানবিকতার পরিচয় হত। বাকি অনুসন্ধান চলতে পারত সমান্তরালে। তাতে আপত্তি করেনি রাজ্য। বরং একাধিক বার সংশোধনমূলক পদক্ষেপ করা হয়েছে। এক কর্তা বলেন, “উপভোক্তা-তালিকা থেকে প্রায় ১৭ লক্ষ নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। তার পরেও গ্রামোন্নয়নে ১২-১৪ হাজার কোটি টাকা আটকে রেখেছে কেন্দ্র!”
আবাস-পর্যবেক্ষণ
• ১০টির মধ্যে ৭টি জেলায় অভিযোগের প্রমাণ হাতে।
• অন্যের জমি অবৈধ ভাবে দখলে রাখার পরেও কোথাও কোথাও সংশ্লিষ্টরাই আবাসের উপভোক্তা।
• অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাড়িতে ‘বাংলা আবাস যোজনা’ লেখা। প্রকল্পের লোগোও ঠিক ভাবে নেই।
• ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ভুল ভাবে নথিবদ্ধ কোনও কোনও জায়গায়।
• আবাস (প্লাস) সমীক্ষা যথাযথ ভাবে করা হয়নি গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে। তালিকায় নাম ছিল অযোগ্যদেরও।
• অযোগ্য ব্যক্তিদের উপভোক্তা তালিকায় সুপারিশ যাচাই দলেরও।
রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী প্রদীপ মজুমদারের প্রতিক্রিয়া, “রাজনৈতিক কারণে বাংলার গরিবদের বঞ্চিত করা হচ্ছে।” রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, ‘‘প্রান্তিক মানুষের প্রাপ্য লুটের শাস্তি পেতেই হবে। তাঁদের কারণেই তো মানুষ মাথার উপর ছাদ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
কেন্দ্রের সুপারিশ
• গরমিলে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এফআইআর।
• সংশ্লিষ্ট বিডিও এবং সুপারভাইজ়রদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ।
• পদক্ষেপে দেরি হলে, সংশ্লিষ্ট জেলা-আধিকারিকদের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিস।
• এই সমস্ত পদক্ষেপের প্রচার।
• বিষয়টি সরাসরি দেখতে মুখ্যসচিবকে অনুরোধ। ১০ মার্চের মধ্যে মন্ত্রকে রিপোর্ট পেশ।
রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে পাঠানো চিঠিতে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের সচিব শৈলেশ কুমার সিংহ লিখেছেন, গত জানুয়ারিতে কেন্দ্রীয় দল রাজ্যের ১০টি জেলায় ঘুরে গিয়েছে। তাদের রিপোর্টে সাতটি জেলাতেই নানা গরমিল ধরা পড়েছে। প্রশাসনিক পর্যবেক্ষকদের মতে, কেন্দ্রের সুপারিশ মেনে আগেই একদফা সংশোধনমূলক পদক্ষেপ করেছিল রাজ্য। তার মধ্যে ছিল প্রকল্পের নাম সংশোধন, উপভোক্তাদের তালিকা ত্রুটিমুক্ত করা ইত্যাদি। কিন্তু এই সব কাজও যে কেন্দ্রের বিচারে যথাযথ হয়নি, তা বুঝিয়ে দিয়েছে তারা। রিপোর্টের নিশানায় থাকা সাত জেলা: পূর্ব মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, পশ্চিম মেদিনীপুর, কালিম্পং, দার্জিলিং এবং নদিয়া।
সূত্রের খবর, মূলত কী কী ত্রুটি কেন্দ্রীয় দলের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, তা স্পষ্ট জানানো হয়েছে (বিস্তারিত সারণিতে)। প্রশাসনের এক কর্তার বক্তব্য, “প্রায় আট মাস বরাদ্দ বন্ধ রাখার পরে আচমকা গত নভেম্বরে প্রকল্প চালুর কথা বলে কেন্দ্র। ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব কাজ শেষ করে চূড়ান্ত অনুমোদনের নির্দেশ দেওয়া হয়। অত অল্প সময়ের মধ্যে তালিকা সংশোধন করে প্রায় ১১ লক্ষ উপভোক্তাকে চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়ার কাজ শেষ করেছে রাজ্য। শুধু পূর্ব মেদিনীপুরেই বাদ গিয়েছে প্রায় ১.৩০ লক্ষ। ফলে আধিকারিকদের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অযৌক্তিক।”
প্রদীপের কথায়, “এ সব বাহানা। অন্য রাজ্যের তুলনায় অনেক স্বচ্ছ ভাবে এ রাজ্যে কাজ হয়েছে। ১৫টি কেন্দ্রীয় দল এসেছে। পদক্ষেপের তথ্য একাধিক বার দেওয়া হয়েছে। ...এ তো রাজ্যের প্রাপ্য টাকা!”