রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। —নিজস্ব চিত্র।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, রাজভবনের সামনে ধর্না দিয়ে রাজ্যপালের আচরণের প্রতিবাদ জানাবেন তিনি। শুনে বৃহস্পতিবার সকালে দিল্লি থেকে ফিরে রাজ্যপাল বললেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আমার সম্মানীয় সহকর্মী। তাঁকে রাজভবনে স্বাগত। তিনি রাজভবনের ভিতরে এসেই তাঁর যাবতীয় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ দেখাতে পারেন। রাজভবনের সম্মাননীয় অতিথি হয়েই আসতে পারেন প্রতিবাদ জানাতে।’’
গত কয়েক সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন নিয়ে রাজ্য এবং রাজভবনের সংঘাত চরমে পৌঁছেছে। এর মধ্যেই মঙ্গলবার শিক্ষক দিবসের মঞ্চ থেকে মমতা সরাসরি রাজ্যপালকে আক্রমণ করে বলেছিলেন, ‘‘আপনার কথায় বিশ্ববিদ্যালয় চলবে না। আমরা টাকা দেব। আর আপনি বিজেপির দালালি করবেন, তা হতে পারে না। এ রকম করলে আমরা টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেব। প্রয়োজনে রাজভবনের সামনে গিয়ে ধর্না দেব আমি।’’ ঘটনাচক্রে, সেই সময় রাজ্যপাল কলকাতায় ছিলেন না। তিনি দিল্লি গিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবার সকালেই তিনি ফেরেন। এবং মুখ্যমন্ত্রীর ধর্নার কথা তাঁকে জানাতেই রাজ্যপাল বোস মুখ্যমন্ত্রীকে ধর্নার জন্য স্বাগত জানান রাজভবনে।
তবে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রতিবাদ জানাতে নিজের বাসভবনে আমন্ত্রণ জানালেও রাজ্যপাল বোস স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির প্রশাসনের ক্ষেত্রে তিনি এ ধরনের কোনও উদারতা দেখাবেন না। একরকম হুঁশিয়ারির সুরেই দিল্লি ফেরত রাজ্যপাল বোস জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য হিসাবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কোনও গন্ডগোল বরদাস্ত করবে না। বরং সমস্যার মূলে যাঁরা, সেই ‘ক্যাম্পাসের নরখাদক’দের উচিত শিক্ষা দেবেন। রাজ্যপাল বলেছেন, ‘‘শিক্ষা মাফিয়াদের একটা শিক্ষা হওয়া দরকার। ক্যাম্পাসের নরখাদকদের তাদের অপকর্মের জবাবদিহি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মেধানাশকারী যে হিংসা চলছে, তাতে অবিলম্বে দাঁড়ি টানা দরকার।’’
বৃহস্পতিবার সকালে দিল্লি থেকে ফিরে রাজ্যপাল যখন এই মন্তব্য করছেন, ঠিক তার আগেই রাজভবনের তরফে রাজ্যপালের একটি ভিডিয়োবার্তা প্রকাশ করা হয়। বাংলা ভাষায় বাংলার মানুষের উদ্দেশে সেই বার্তা দিয়েছেন রাজ্যপাল। সেখানেও রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে একই রকম হতাশার কথা বলতে শোনা গিয়েছে রাজ্যপালকে। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে কেন উপাচার্যদের পদত্যাগ করতে হয়েছিল, কেনই বা নিয়োগ করতে অস্থায়ী উপাচার্যদের। পদত্যাগী উপাচার্যেরা তাঁর কাছে কী অভিযোগ করেছেন, কেনই বা তিনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সংস্কারের কাজে ব্রতী হলেন— সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন রাজ্যপাল।
বস্তুত, এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে রাজ্য সরকার এবং শিক্ষা দফতরকেই দোষী ঠাওরেছেন তিনি। এমনকি, যাদবপুরের ছাত্রমৃত্যুর ঘটনা যে আসলে এই অপশাসনেরই প্রমাণ, তা-ও বলেছেন তিনি। রাজ্যপালের এই অভিযোগের পাল্টা জবাবে শাসকদল তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, ‘‘রাজ্যপাল বোস আসলে সব এলোমেলো করে দিতে চাইছেন। তিনি জটিলতা তৈরি করছেন। যার প্রভাব পড়ছে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থায়। যা আসলে বিজেপির অ্যাজেন্ডা।’’
রাজ্যপাল তাঁর ভিডিয়োবার্তায় বলেছেন, ‘‘আমি কাউকে পদত্যাগ করতে বলিনি। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই সমস্ত উপাচার্যদের পদত্যাগ করতে হয়। ওঁরা নিজেরাই ইস্তফা দেন। বাধ্য হয়েই আমাকে অন্তর্বর্তিকালীন উপাচার্য নিয়োগ করতে হয়। আপনারা জানতে চাইতে পারেন, কেন সরকারের মনোনীত উপাচার্যকে নিয়োগ করিনি? আসলে কেউ ছিলেন দুর্নীতিগ্রস্ত, কেউ ছাত্রীকে হেনস্থা করেছেন, কেউ রাজনৈতিক খেলা খেলছিলেন। তা হলে বলুন এমন উপাচার্য নিয়োগ করব বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাথায়?’’
যদিও রাজ্যপালের এই বক্তব্যকে ‘সুপরিকল্পিত একটি চিত্রনাট্য’ বলে কটাক্ষ করেছেন কুণাল। তিনি বলেন, ‘‘উনি ওই চিত্রনাট্য নিয়ে বিজেপির এজেন্টের কাজ করছেন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কী হয়েছে সবাই দেখেছে। তা নিয়ে তদন্তও হচ্ছে। কিন্তু রাজ্যপাল কোথা থেকে কাদের ধরে ধরে এনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মাথায় বসাচ্ছেন! যাঁরা শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত নন। কিন্তু ঘোষিত বিজেপি।’’
বাংলায় বলা ভিডিয়োবার্তায় রাজ্যবাসীকে ভাইবোন বলে সম্বোধন করেছেন রাজ্যপাল বোস। বলেছেন, ‘‘বাংলা আমার স্বপ্নের কর্মভূমি। আমি এখানে এসেছি ভাল কাজ করব বলে। যে পাঁচ জন উপাচার্য পদত্যাগ করেছিলেন তাঁরা নিজেরা আমাকে বলেছেন, তাঁদের জীবনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ভয়েই পদত্যাগ করেছেন তাঁরা। কারণ সরকারি অফিসার, মুখ্যমন্ত্রীর আইএএস অফিসার তাঁদের উপর চাপ সৃষ্টি করছিলেন। শিক্ষা দফতরের তরফে তাতে উৎসাহও দেওয়া হয়েছিল।’’ ভিডিয়োবার্তায় রাজ্যপাল নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং স্বামী বিবেকানন্দের নামে শপথ করে বলেছেন, ‘‘দুর্নীতিমুক্ত ক্যাম্পাস এবং শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য আমি শেষ পর্যন্ত এই লড়াই লড়ে যাব। কারণ বিবেকানন্দ শিখিয়েছেন, যত ক্ষণ না উদ্দেশ্য পূর্ণ হচ্ছে ওঠো, জাগো, লক্ষ্যপূরণের উদ্দেশে এগিয়ে যাও।’’
যদিও কুণালের বক্তব্য, ‘‘রাজ্যপালের যদি কিছু বলার থাকে তবে তিনি শিক্ষামন্ত্রীকে ডাকুন। তাঁর সঙ্গে বৈঠক করুন যেটা এক্তিয়ারে, সংবিধানে, নিয়ম রীতিতে আছে। তাঁর উচিত অবিলম্বে শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে ডেকে মুখোমুখি আলোচনা করা।’