মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ হিসাবে কোন দিনটি পালন করবে বাংলা? এ বিষয়ে বাংলার বিশিষ্ট জন এবং রাজনৈতিক দলগুলির মতামত জানতে সর্বদল বৈঠক ডেকেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেখা গেল, সেখানে পছন্দের পাল্লায় ওজন ভারী পয়লা বৈশাখের। তবে তাকে টক্কর দেওয়ার মতো বেশ কয়েকটি ‘দাবিদার’ও রয়েছে। তার মধ্যে অক্ষয় তৃতীয়া, রাখি পূর্ণিমার মতো দিন যেমন রয়েছে, তেমনই আলোচনায় উঠে এসেছে ১৫ অগস্ট, ২৩ জানুয়ারি, এমনকি, বঙ্গভঙ্গ রদের ঐতিহাসিক দিন ১২ ডিসেম্বরও। পছন্দ নিয়ে আপাতত ঐকমত্য না-হলেও অপছন্দের বিষয়টিতে একবাক্যে সহমত হয়েছেন সবাই। রাজনীতি থেকে ধর্ম, জাতি, সংস্কৃতি নির্বিশেষে সবাই মেনেছেন, আর যা-ই হোক ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস হতে পারে না। ঘটনাচক্রে, যে দিনটি এই বছরই রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের উদ্যোগে রাজভবনে পালিত হয়েছে। যার ‘প্রতিবাদ স্বরূপ’ মুখ্যমন্ত্রীর ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ ঠিক করার ভাবনা। মঙ্গলবারের এই বৈঠকে বিশিষ্ট জনেরা উপস্থিত হলেও রাজনৈতিক দল হিসাবে সিপিএম, কংগ্রেস বা বিজেপির কোনও প্রতিনিধি আসেননি। একমাত্র এসইউসি এবং সিপিআইএমএল (লিবারেশন)-এর প্রতিনিধি এসেছিলেন।
তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, ২০ জুন দিনটিকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে মানতে আপত্তি জানিয়েছে ‘হিন্দু মহাসভা’ও। মঙ্গলবার নবান্নের সর্বদল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার তরফে চন্দ্রচূড় গোস্বামী। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দলের ইতিহাস রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের থেকেও পুরনো। আমরা প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। তবে আমরাও মনে করি ২০ জুন কখনওই পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করা যায় না। কারণ এই দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে বাঙালির বেদনার ইতিহাস।’’ বিজেপি যে দলের আদর্শপুষ্ট বলে মনে করা হয়, সেই আরএসএসেরও আদি দল হিন্দু মহাসভা এ ভাবে তৃণমূল শাসিত সরকারের সিদ্ধান্তের পাশে দাঁড়ানোয়, বিষয়টিকে তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
গত ২০ জুন রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করেছিলেন রাজ্যপাল বোস। কিন্তু ওই দিনটিকে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ মানতে নারাজ মুখ্যমন্ত্রী। প্রথমে ফোনে অনুরোধ জানিয়ে এবং পরে চিঠি লিখে রাজ্যপালকে এই আয়োজন থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় থেকে রাজভবনে ওই দিনই ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন করেন রাজ্যপাল। এর পাল্টা জবাব দিতে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ কবে, তা ঠিক করতে একটি কমিটি গঠন করেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ তথা ইতিহাসবিদ সুগত বসুকে উপদেষ্টা করে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস নির্ধারণ কমিটি’ তৈরি হয়। আহ্বায়ক করা হয় বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই কমিটির বৈঠকে পয়লা বৈশাখকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করার সুপারিশও করা হয়েছিল। এর পরেই মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন, বাংলার বিভিন্ন মহলের বিশিষ্ট জনেদের ডেকে এ ব্যাপারে মতামত জানতে চাওয়া হবে। সেই মতো মঙ্গলবার নবান্নে সভাঘরে ডাকা হয়েছিল বৈঠক।
প্রায় দু’ঘণ্টার আলোচনায় অবশ্য কোনও নির্দিষ্ট দিন নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে ওই বৈঠক থেকে উঠে আসা প্রস্তাবগুলি নিয়ে আগামী ৭ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন সভায় উপস্থিত বিধানসভার স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গের ‘রাজ্য সঙ্গীত’ নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলেও বদলে যায় শেষ মুহূর্তে। মুখ্যমন্ত্রী প্রায় ঘোষণা করেই ফেলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’ গানটিকে রাজ্যসঙ্গীত হিসাবে গাওয়া হবে। কিন্তু তা নিয়েও শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য হতে পারেননি উপস্থিত বিশিষ্ট জনেরা। মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন, বাংলার মাটি গানটির কয়েকটি শব্দ বদলাতে। ‘বাঙালি’ শব্দটির বদলে ‘বাংলা’ শব্দের প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেই প্রস্তাব নিয়ে শেষ পর্যন্ত সহমত হতে পারেননি সকলে। তাই এ নিয়েও সিদ্ধান্ত পিছিয়ে যায়।
মঙ্গলবারের সভায় উপস্থিত ছিলেন জয় গোস্বামী, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি, সুবোধ সরকার, আবুল বাশার, সুগত বসু, শুভাপ্রসন্ন, গৌতম ঘোষ, প্রচেত গুপ্ত, রাজ চক্রবর্তী, সুদেষ্ণা রায়ের মতো শিল্প-সাহিত্য জগতের বিশিষ্টরা। পাশাপাশি ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম, চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য, ব্রাত্য বসু, ইন্দ্রনীল সেন, বীরবাহা হাঁসদারাও। ছিলেন সংবাদমাধ্যম, বাণিজ্যিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল এমনকি, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের প্রধানেরাও।
গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ
সভার শুরুতেই রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব তথা মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উপদেষ্টা আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ঝাড়খণ্ড বা উত্তরাখণ্ড পরে রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বিধানসভায় বাংলার প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে কিছু রেকর্ড নেই।’’ এর পরেই একে একে বিশিষ্টদের নাম ধরে ডেকে তাঁদের মতামত জানাতে অনুরোধ করেন মমতা। জয় বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে মুখ্যমন্ত্রী যে পথে চালিত করবেন, আমি তাকেই সমর্থন করব।’’ নৃসিংহপ্রসাদ বলেন, ‘‘বাংলার ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে যে দিন রবীন্দ্রনাথ বাংলার সমস্ত মানুষকে পরষ্পরকে রাখি বাঁধার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, সে দিন বাংলায় সমস্ত জাতি সমস্ত বর্ণের মানুষ সানন্দে উৎসবে যোগ দিয়েছিলেন, তাই রাখিপূর্ণিমার দিনটিকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করলে ভাল হয়।’’ পরে কামতাপুরী অ্যাকাডেমির বাজলে রহমান পশ্চিমবঙ্গ দিবসকে ‘বাংলা দিবস’ হিসাবে পালন করার প্রস্তাব দিলে, তাকে সমর্থন করেন নৃসিংহপ্রসাদ। তিনি জানান, বাংলা থেকে ‘পশ্চিম’কে বাদ দেওয়াই ভাল। কবি সুবোধ সরকার জানান, পয়লা বৈশাখ দিনটি সমস্ত বাঙালির আবেগকে প্রতিফলিত করে। তাই ওই দিনটিই বাছা হোক। সাহিত্যিক আবুল বাশারও পয়লা বৈশাখকেই পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করার পক্ষে মত দিয়েছেন।
তবে মঙ্গলবার পশ্চিমবঙ্গ দিবস নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে উঠে আসে বাংলার ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ের কথা। স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গ দিবস সংক্রান্ত কমিটির উপদেষ্টা তথা ইতিহাসবিদ সুগতই জানান, পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পয়লা বৈশাখের পাশাপাশি ১৯ অগস্ট দিনটির কথাও মনে হয়েছে তাঁর। কারণ, ওই দিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সুভাষচন্দ্র বসু একত্রে মহাজাতির আহ্বান করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে ১২ ডিসেম্বর তারিখটি পালন করার কথা বলেন এসইউসি-র অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর যুক্তি ওই দিন বঙ্গভঙ্গ রদ হয়েছিল। লিবারেশন পার্টির কার্তিক পাল বলেন, ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর এই রাজ্য নতুন রূপে গঠন হয়। তার পর থেকেই বাংলা-সহ বিভিন্ন রাজ্যের মানচিত্র তৈরি হয়। তবে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে বাংলার বহুত্ববাদী সংস্কৃতি এবং বাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে কোনও উজ্জ্বল দিনকে বেছে নেওয়া উচিত। সাহিত্যিক নৃসিংহপ্রসাদ টেনে আনেন শশাঙ্কের আমলের বাংলার কথা। উল্লেখ্য, নৃসিংহের কথায় প্রথমটায় ইতিহাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় যেতে বারণ করলেও পরে মমতা নিজেও ইতিহাসের আলোচনায় যোগ দেন। দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমির তরফে মনোরঞ্জন ব্যাপারী ‘১৮৯৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ হয়েছে’ বলে মন্তব্য করার সঙ্গে সঙ্গে মমতা শুধরে দেন। তিনি বলেন, ‘‘সিপাহী বিদ্রোহ ১৮৫৭ সালে হয়েছিল।’’
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন ২৩ জানুয়ারিকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করার প্রস্তাবও ওঠে মঙ্গলবারের বৈঠকে। এক সাংবাদিক ওই প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘‘নেতাজি ছিলেন সংগ্রামী বাঙালির প্রতীক। তাই এ বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে।’’ অন্য দিকে, শিল্পী শুভাপ্রসন্ন বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী যে দিন বাংলাকে বিশ্ব বাংলা হিসাবে ভেবেছেন, আমার মতে সেই দিনটাকে বিশ্ব বাংলা দিবস হিসাবে পালন করা যেতে পারে।’’ এ কথা শুনে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জানান, তিনি নিজেই ভুলে গিয়েছেন, কবে সেই তারিখ। মঙ্গলবার শুভাপ্রসন্নকে সমর্থন করে বিশ্ব বাংলা দিবসের কথা বলেন পরিচালক গৌতম ঘোষও। তিনি বলেন, তারিখ যা-ই হোক দিনটির নাম হোক বিশ্ববাংলা দিবস। একই কথা বলেন তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষও।
মঙ্গলবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন নাখোদা মসজিদের ইমাম, দক্ষিণেশ্বরের কালিবাড়ির প্রতিনিধি কুশল চৌধুরী, আর্চবিশপ টমাস ডি’সুজা, এমনকি, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাও। তাঁরাও হয় পয়লা বৈশাখ নয়তো মুখ্যমন্ত্রীর পছন্দের যে কোনও তারিখে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করা হোক বলে মত দিয়েছেন।
নবান্নে মঙ্গলবার রাজ্য সঙ্গীত নিয়েও নিজেদের মতামত জানান বিশিষ্ট জনেরা। ‘বাংলার মাটি’ গানটির পাশাপাশি ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা’ গানটির প্রস্তাবও ওঠে। অবশ্য একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীকে একটি গান রচনার কথাও বলেন কেউ কেউ। যেটি রাজ্য সঙ্গীত হিসাবে সমস্ত অনুষ্ঠানে বাজানো হবে। কণ্ঠ দেবেন তারকা শিল্পীরা। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের গানটিই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত আবার পিছিয়ে যায়।
তবে সিদ্ধান্ত না হলেও মঙ্গলবার সবাই এক বাক্যে মেনে নিয়েছেন, আর যা-ই হোক ২০ জুন পশ্চিমবঙ্গ দিবস পালন করা হতে পারে না। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার ভোটাভুটিতে বাংলা ভাগের বিষয়টি স্থির হয়েছিল। বাংলা দু’ভাগে ভাগ হয়ে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিমবঙ্গ তৈরি হয়। পশ্চিমবঙ্গ ভারতে অন্তর্ভুক্ত হয়। বাংলাদেশ আলাদা হয়। অনেক বাঙালির কাছেই সেই স্মৃতি বেদনার। তাই ২০ জুনকে পশ্চিমবঙ্গ দিবস হিসাবে পালন করার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তকে এক যোগে নাকচ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট জনেরা।