সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সের সমাবর্তনে। পিটিআই।
দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় বিচারব্যবস্থার কাছে আর্জি জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রবিবার এক অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিতের উপস্থিতিতে ভারতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে বিচারব্যবস্থার উদ্দেশে মমতা বলেন, “দয়া করে গণতন্ত্রকে রক্ষা করুন।”
রবিবার দ্য ওয়েস্ট বেঙ্গল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিকাল সায়েন্সস (এনইউজেএস)-এর সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি ললিত। সেই অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রের বর্তমান অবস্থা নিয়ে মন্তব্য করেন, “এক দল লোকের হাতে আজ গণতন্ত্র কুক্ষিগত এবং খর্ব। এই অবস্থা যদি চলতে থাকে, তা হলে ক্রমশ তা (দেশকে) রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অক্ষুণ্ণ থাকা উচিত।” এই সূত্রেই বিচারব্যবস্থাকে গণতন্ত্র রক্ষার আবেদন জানান তিনি।
বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেস, সকলেই মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনায় সরব। এটা নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থাকে ‘প্রভাবিত’ করার চেষ্টা বলেও অভিযোগ তোলা হয়েছে।
এ দিনের অনুষ্ঠানে দেশের প্রধান বিচারপতি ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকি, কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসু এবং কলকাতা হাই কোর্টের একাধিক বিচারপতিও। সেখানে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কার্যকাল নিয়েও নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেন মমতা। প্রধান বিচারপতি হিসেবে ললিত মাস দুয়েক হল দায়িত্ব পালন করছেন। সেই প্রসঙ্গ উত্থাপন করে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “দু’মাসেই আমরা দেখেছি, বিচার ব্যবস্থা কাকে বলে!”
৮ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অবসর নেবেন উদয় উমেশ ললিত। তার পরে সেই পদে বসবেন বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। এই পরিস্থিতিতে মমতার এ দিনের বক্তব্য ‘অর্থপূর্ণ’ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশ।
বিজেপি-বিরোধীদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে কার্যত সমালোচকদের বাগে আনতে চাইছে মোদী সরকার। সম্প্রতি কেন্দ্রের একাধিক পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। তার মধ্যে নবতম সংযোজন প্রতি রাজ্যে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির শাখা খোলার ঘোষণা। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির নামোল্লেখ করেননি। তবে অনেকেই মনে করছেন, নাম না করেও কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারকেই নিশানা করেছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতার পরে দেশের প্রধান বিচারপতি ললিতের বক্তৃতায় অবশ্য সরাসরি বিচারব্যবস্থা, দেশের গণতন্ত্র ইত্যাদির উল্লেখ ছিল না। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে তিনি যে বক্তৃতা করেন, তাতে মূলত আইনজীবীদের কাজ, পড়াশোনা, দায়িত্ব ইত্যাদি নানা বিষয়ের উল্লেখ মিলেছে।
মুখ্যমন্ত্রী এর আগে নানা বক্তৃতায় বিচারব্যবস্থায় গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে নিজের মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। এ দিনও সেই প্রসঙ্গ তুলেছেন তিনি। বিচারব্যবস্থার প্রতি তাঁর সম্মান এবং আস্থা জানিয়েও মমতা বলেছেন, বহু ক্ষেত্রে আদালতের বিচারের আগেই গণমাধ্যমে বিচার (মিডিয়া ট্রায়াল) হচ্ছে। সেই প্রক্রিয়া যে বিচারব্যবস্থার পরিপন্থী, তা-ও জানান তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর মতে, এই ধরনের কার্যকলাপ অপরাধ সাব্যস্ত হওয়ার আগেই মানুষের সম্মান নষ্ট করে। তিনি বলেন, “সম্মান মানুষের সব থেকে দামী জিনিস। সম্মান এক বার গেলে তা ফিরে পাওয়া যায় না।” তাঁর ক্ষেত্রেও এমন হয়েছে, সেই ইঙ্গিত জোরালো ভাবে দিয়ে মমতা বলেন, “আমার সম্মান নষ্ট করবেন না।”
মমতার এই বক্তব্য নিয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের ব্যাখ্যা, সম্প্রতি স্কুল নিয়োগ দুর্নীতি-সহ একাধিক ঘটনায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আঙুল উঠেছে। জেলে গিয়েছেন তৃণমুলের মন্ত্রী, বিধায়ক। বহু ক্ষেত্রে দুর্নীতির সঙ্গে পরোক্ষে কিংবা প্রত্যক্ষ ভাবে মুখ্যমন্ত্রীকে বিদ্ধ করেছেন বিরোধী এবং আমজনতার অনেকে। মিডিয়া ট্রায়ালের সমালোচনা করতে গিয়ে কি পরোক্ষে ওই আক্রমণের কথাই তুলে ধরেছেন তিনি, উঠেছে সেই প্রশ্নও।
মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যকে কটাক্ষ করতে ছাড়েননি বিরোধীরা। সিপিএমের আইনজীবী-সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে চলছে, তা সমর্থনযোগ্য নয় কোনও ভাবেই। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু তার নাম করে দুর্নীতি করবেন, আবার আইনত ব্যবস্থা নিলে সম্মানহানি হচ্ছে বলে কান্নাকাটি করবেন, তা তো হতে পারে না! দু’টি একে অপরের পরিপূরক হতে পারে না কখনওই। গণতান্ত্রিক কাঠামোকে টিকিয়ে রাখতে গেলে, সংবিধানে উল্লিখিত যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতি মেনে চলতে হবে কেন্দ্র ও রাজ্য, দুই সরকারকেই।’’
রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘কেন্দ্রীয় সংস্থার সক্রিয়তার মধ্যে দিয়ে রাজ্যে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির হদিস পাওয়া গিয়েছে। উনি (মমতা) কি চাইছেন রাজনৈতিক নেতাদের লুঠ সর্বজনীন হয়ে উঠুক? দিনের আলোয় শত কোটি টাকার হদিস পাওয়া যাচ্ছে। এর পরেও উনি বলবেন, দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা যাবে না?’’ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর মন্তব্য, ‘‘বিচারপতিরা যখন দৃঢ়তা দেখিয়ে রায় দেন, শাসক দলের তখন পছন্দ হয় না! নানা ভাবে চোখ রাঙিয়ে নিরপেক্ষ বিচারকে প্রভাবিত করাই শাসক দলের নেতৃত্বের এবং সরকারের উদ্দেশ্য। বিভিন্ন ছোট ছোট মন্তব্যে সেটাই ধরা পড়ছে।”