বিজেপি কর্মী মনোজ জয়সওয়ালের খুনের তদন্তে সিবিআই। রবিবার নলহাটিতে। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
বিধানসভা ভোটের ফল ঘোষণার (২ মে) পরের দিন, ৩ মে পূর্ব বর্ধমানের জামালপুরের নবগ্রামে এক বিজেপি কর্মীর মা কাকলি ক্ষেত্রপাল এবং দুই তৃণমূলকর্মী বিভাস বাগ ও শাজাহান শা খুন হন বলে অভিযোগ। রবিবার সিবিআইয়ের তদন্তকারী দল কাকলিদেবীর বাড়িতে গেলেও নিহত দুই তৃণমূলকর্মীর বাড়িতে যায়নি।
এতে শুধু যে স্থানীয় তৃণমূলের তরফেই তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, তা-ই নয়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী দলের এই ধরনের আচরণের প্রেক্ষিতে তাদের বিরুদ্ধে ‘আমরা-ওরা’ বিভাজনের অভিযোগও তীব্রতর হচ্ছে। পর্যবেক্ষক শিবিরের বক্তব্য, শুধু জামালপুরের ওই ঘটনা নয়, ভোট-পরবর্তী হিংসার তদন্তে সিবিআই এ দিন উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দাপিয়ে বেড়ালেও তাদের নানান কর্মকাণ্ডে নিরপেক্ষতার অভাব ও অসঙ্গতি স্পষ্ট। যেমন, কলকাতা হাই কোর্টের নির্দেশ, ভোটের পরে যেখানে খুন বা ধর্ষণের অভিযোগ আছে, সিবিআইয়ের দায়িত্ব শুধু সেই ঘটনাগুলিরই তদন্ত করা। কিন্তু এ দিন সিবিআইয়ের দলকে এমন বাড়িরও কড়া নাড়তে দেখা গিয়েছে, যেখানে খুন বা ধর্ষণ কিছুই ঘটেনি। সেখানে অভিযোগ, তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের অত্যাচারে বিজেপি কর্মীরা বাড়ি ফিরতে পারছেন না। কোথাও বা অভিযোগ, বিজেপি কর্মী আহত হয়েছেন। কোথাও কোথাও খুন হয়ে যাওয়া তৃণমূলকর্মীর বাড়িতেও যেতে দেখা গিয়েছে সিবিআই-কে।
সিবিআই এ দিন হাওড়ার যে-তিন বাড়িতে যায়, তাদের কেউই ভোট-পরবর্তী হিংসায় খুন হননি। হয়নি ধর্ষণও। অভিযোগ, ভোটের ফল বেরোনোর পরে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা ইট মেরে লিলুয়া-বেলগাছিয়ার বিজেপি কর্মী সঞ্জয় দাসের বাঁ চোখ নষ্ট করে দেয়। সঞ্জয় ঘরছাড়া। সিবিআই তাঁর স্ত্রী দেবলীনার সঙ্গে দেখা করে মেডিক্যাল রিপোর্ট ও এফআইআর সংগ্রহ করে। লিলুয়ার ভূতবাগানে বিজেপির ঘরছাড়া কর্মী রঞ্জিত দাসের বাড়ি গিয়ে সিবিআই তাঁর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে। বাঁকড়ার রাজীবপল্লিতে যে-সব বিজেপি কর্মীর বাড়িতে তৃণমূলের হামলার অভিযোগ আছে, এ দিন সেখানে গিয়েও জখম বিজেপি কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সিবিআই। অথচ উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তাদের এই সব ঘটনার তদন্ত করার কথা নয়।
কোচবিহারের চিলাখানায় ৫ মে তৃণমূলকর্মী শাহানুর রহমানকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুনের অভিযোগ ওঠে বিজেপির বিরুদ্ধে। তৃণমূলকর্মী প্রসেনজিৎ সাহাকে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। অভিযুক্ত বিজেপি কর্মী রাম পাল ও বাসুদেব পাল ধরা পড়ে। সিবিআইয়ের ১৬ সদস্যের দল এ দিন রামের বাড়িতে যায়, প্রসেনজিতের ভাই বিশ্বজিতের সঙ্গেও কথা বলে। শাহানুরের দিদি সায়রার অভিযোগ, পুলিশ অকুস্থলের অদূরে অস্ত্র পেলেও সিবিআইয়ের সামনে চেপে যায়। তদন্তকারী দুই পুলিশ অফিসারকে ডেকে পাঠিয়েছে সিবিআই।
২০ মে রাতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুরের খেয়াদহে বাড়িতে ঢুকে বিজেপি কর্মী নির্মল মণ্ডল (৩২)-কে খুন করা হয় বলে অভিযোগ। আহত নির্মল-পত্নীর অভিযোগ নেয় সিবিআই। তাঁর অভিযোগ, তাঁকে যৌন হেনস্থা করা হয়েছিল। ষড়যন্ত্রী দুই তৃণমূল নেতা গ্রেফতার হননি। সিবিআই জানায়, নতুন মামলা হবে। তারা ডায়মন্ড হারবারের রামনগরে নিহত রাজু সামন্তের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলে।
এ দিন পূর্ব বর্ধমানের দু’টি মামলার তদন্তভার নেয় সিবিআই। ১৮ এপ্রিল কাঞ্চননগরে বিজেপি-তৃণমূল সংঘর্ষে আহত নারায়ণ দে-র মৃত্যু হয় ৬ মে। দেওয়ানদিঘিতে সোম হাঁসদা নামে এক ব্যক্তির দেহ গাছে ঝুলছিল। কেতুগ্রামের শ্রীপুরে বলরাম মাঝি নামে এক বিজেপি কর্মী খুন হন। এ দিন সেখানেও যায় সিবিআই।
বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ এ দিন মেদিনীপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্দেশে বলেন, “যে-ভাবে সিবিআই লেগেছে, নেতাদের আগে বাঁচান! সিবিআই কী জিনিস, আপনারা (মমতারা) জানেন বলেই আগে দাবি করতেন, ‘সিবিআই চাই’, ‘সিবিআই চাই’। এখন জানেন যে, আপনাদের ভিতরে যেতে হবে। তাই বলছেন, সিবিআই চাই না।’’
তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেন, “বিজেপি এখন সিবিআই-কে নিজেদের স্বার্থে কাজ করাচ্ছে। অনেকে বাঁচতে বিজেপিতে যাচ্ছেন। সেখানে গেলে দোষী হলেও নিশ্চিন্ত আশ্রয় পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বিজেপিতে না-থাকলে নির্দোষ হলেও হেনস্থা! এই কারণেই দিলীপবাবু বড় বড় কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন।”