উৎসবের রেশ থাকতে থাকতেই ‘নীলবাড়ি’ দখলের লড়াই গতি পেতে শুরু করল পশ্চিমবঙ্গে। —ফাইল চিত্র।
নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর সভার পাল্টা তৃণমূলের সভা। উত্তরবঙ্গে রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষের কনভয়ে ইটবৃষ্টি। কাঁথির অধিকারী বাড়িতে ভোট-কুশলী প্রশান্ত কিশোরের সফর। রাজ্য কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর নাম না করে তৃণমূলের ‘বিক্ষুব্ধ’দের কংগ্রেস ফেরার আহ্বান। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একের পর এক জনহিতকর প্রকল্পের ঘোষণা। দুর্গাপুজোর আবহ শেষে দীপাবলি উৎসবের রেশ থাকতে থাকতেই ‘নীলবাড়ি’ দখলের লড়াই গতি পেতে শুরু করল পশ্চিমবঙ্গে। একদিকে শাসক তৃণমূল, অন্যদিকে বিরোধী বিজেপি— উভয় শিবিরই লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়েছে। বিধানসভা ভোটের আর বাকি মেরেকেটে ছ’মাস। তার পরেই বোঝা যাবে, কারা দখল করবে ‘নবান্ন’। কারা দখল করবে ‘নীলবাড়ি’।
প্রসঙ্গত, আগে রাজ্য প্রশাসনের সদর দফতর ছিল বিবাদী বাগের গোলদিঘির পাড়ের ‘মহাকরণ’। যা পরিচিত ছিল ‘লালবাড়ি’ হিসেবে। সেই লালবাড়ি দখলের লড়াইয়ে ২০১১ সালে জিতেছিলেন মমতা। কার্যত একার হাতে তিন দশকেরও বেশি সময়ের বামশাসনের অবসান ঘটিয়ে তিনি পায়ে হেঁটে প্রবেশ করেছিলেন লালবাড়িতে। কালক্রমে মমতা তাঁর প্রশাসনের সদর কার্যালয় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন নবান্নে। যে বহুতল ভবনের চতুর্দশ তলায় মুখ্যমন্ত্রীর দফতর। রাজ্যের বাকি মন্ত্রীদের অধিকাংশই বসেন বাকি তলাগুলিতে। অর্থাৎ, রাজ্য প্রশাসনের বেশিরভাগ কাজকর্ম নিয়ন্ত্রিত হয় ওই বাড়ি থেকেই। এমনিতে নীল-সাদা রংয়ের হলেও গঙ্গা পশ্চিমকূলের বহুতলের মাথার উপর যে রংয়ে বাংলায় ‘নবান্ন’ নামটি লেখা রয়েছে, সেটি নীল। সেই সূত্রেই বাড়িটিকে ‘নীলবাড়ি’ বলেও অভিহিত করা হয়ে থাকে।
২০২১ সালে তাই ‘নীলবাড়ির লড়াই’ দেখতে চলেছে এই রাজ্য।
দীর্ঘদিনের বামশাসনে মহাকরণকে ‘লালবাড়ি’ বলে অভিহিত করার কারণ হিসেবে তার লাল রং ছাড়া রাজনীতির রং-ও ছিল। বামেদের লাল পতাকার সঙ্গে মিলিয়েও মহাকরণকে ‘লালবাড়ি’ বলে অভিহিত করা হত। তৃণমূলের কোথাও স্বভাবতই, লালের ছিঁটেফোঁটা নেই। বরং তাদের রং (পরিভাষায় ‘ব্র্যান্ড কালার’) সবুজ। কিন্তু নীল রং-ও মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিশেষ পছন্দের। নবান্নকে ‘নীলবাড়ি’ বলে অভিহিত করার সেটাও একটি কারণ। তা ছাড়া, লাল এবং নীল সম্পূর্ণ বিপরীতমুখীও বটে। ফলে ‘লালবাড়ি’ ছেড়ে মমতা যে ‘নীলবাড়ি’ থেকে তাঁর রাজ্য পরিচালনা করবেন, তা-ও অস্বাভাবিক নয়।
আরও পড়ুন: কাঁথির অধিকারী বাড়িতে ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোর, ছিলেন না শুভেন্দু, কথা হল শিশিরের সঙ্গে
আগামী বছর নীলবাড়ি দখলের লড়াইয়ের অব্যবহিত আগে পশ্চিমবঙ্গ ২০১৯ সালের লোকসভা ভোট দেখেছে। তাতে বিরোধী বিজেপি ভাল ফল করেছিল। রাজ্যে তাদের আসনসংখ্যাও বেড়েছিল। লোকসভা ভোটের সেই ফলাফলের নিরিখে দেখা যাচ্ছে, রাজ্যে মোট ২৯৪টি বিধানসভা আসনের মধ্যে তৃণমূল এগিয়েছিল ১৬৪টি আসনে। বিজেপি ১২১টি আসনে। শাসক শিবিরের দাবি, তারা ওই ১৬৪টি সংখ্যাটিকে অন্ততপক্ষে ২০০ পার করিয়ে দেবে। মুখ্যমন্ত্রীর মমতার আমলে গত ১০ বছরে গোটা রাজ্যে যে উন্নয়নের ‘মহাযজ্ঞ’ হয়েছে, তাতে উপকৃত হয়েছেন রাজ্যের সমস্ত স্তরের মানুষ। তাঁরা সেই উন্নয়নকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই আবার মমতাকে নীলবাড়ির দখল দেবেন। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে মমতা একাই লড়ে পেয়েছিলেন ২১৩টি আসন। যা পরে আরও বেড়েছে। পক্ষান্তরে, বিরোধী বিজেপি-র বক্তব্য, এ বার রাজ্যের মানুষ ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে ‘বদল’ চাইছেন। তাই নীলবাড়িতে তারাই বসবে। বিহার ভোটে এনডিএ-র জয় তাদের আরও আশাবাদী করেছে। আবার নামমাত্র ব্যবধানে বিহারে বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ-র ক্ষমতায় আসা এবং বিরোধী তেজস্বী যাদবের তুল্যমূল্য লড়াই খুশি করেছে বিহারের পাশের রাজ্য বাংলার শাসক তৃণমূলকেও। যে কারণে লাল প্রসাদের পুত্র তেজস্বীকে ফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন মমতা। অর্থাৎ, বাংলার আগে বিহারের ভোট কোনও শিবিরকেই নিঃসংশয় ভাবে এগিয়ে বা পিছিয়ে রাখেনি।
আরও পড়ুন: শুভেন্দুর মুখে ফের দলনেত্রী, চরৈবেতি মন্ত্রও
ঘটনাপ্রবাহ বলছে, গঙ্গাপাড়ের নীলবাড়ি দখলের লড়াই কার্যত আড়াআড়ি দু’ভাগে বিভক্ত। যুযুধান দুই শিবিরে রয়েছে তৃণমূল এবং বিজেপি। রাজ্যের রাজনীতিতে তৃতীয় শক্তি হিসেবে জমি তৈরির চেষ্টা করছে বাম-কংগ্রেস। এটা নিশ্চিত যে, তারা জোটবদ্ধ শক্তি হিসেবেই বিধানসভায় লড়বে। প্রসঙ্গত, গত লোকসভা ভোটে রাজ্যে সিপিএম তথা বামেরা একটি আসনও পায়নি। কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্রই দু’টি আসন। স্বভাবতই তাদের শতাংশের হিসেবে তাদের ভোটও কমেছিল। সেক্ষেত্রে তারা নীলবাড়ির লড়াইয়ে কতদূর কী করতে পারে, তা-ও দেখার।
কে জিতবে ‘নীলবাড়ির লড়াই’— তাকিয়ে থাকবে পশ্চিমবঙ্গ। তাকিয়ে থাকবে গোটা দেশও।