পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের ওয়েবসাইটে তাঁদের নামের পাশে লেখা আছে ‘নট এমপ্যানেলড’। অর্থাৎ মেধা-তালিকায় তাঁদের নামই নেই। অথচ শিক্ষাগত যোগ্যতার নথি যাচাইয়ের জন্য আজ, মঙ্গলবার পর্ষদের অফিসে ডেকে পাঠানো হচ্ছে দুই প্রার্থীকে! নথিপত্র ঠিক থাকলে শিক্ষক হিসেবে তাঁদের নিয়োগ করার পরিকল্পনাও রয়েছে বলে পর্ষদ সূত্রের খবর।
গুঞ্জন শুরু হয়েছে এই নিয়েই। অনেকের প্রশ্ন, ৪২ হাজার ৯৪৯ জনের প্রার্থী-তালিকা যদি চূড়ান্ত হয়ে গিয়েই থাকে, তা হলে কী ভাবে ওই দু’জনকে নিয়োগ করা হবে? শুধু ওই দু’জন, নাকি আরও অনেকে এ ভাবে ডাক পাচ্ছেন, সেই প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। পর্ষদের বক্তব্য, হ্যাক এবং জালিয়াতির ভূতের ভয়ে তাদের ওয়েবসাইটে প্রার্থী-তালিকা প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু ওই তালিকা প্রকাশ না-করার পিছনে অন্য রহস্য দেখছে শিক্ষা মহল। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা টেট-এর ফল ওয়েবসাইটে না-দেওয়ায় কারচুপির আশঙ্কা করছিলেন বহু প্রার্থী, অভিভাবক এবং শিক্ষাজগতের অনেকে। তাঁদের অভিযোগ, সাইটে প্রার্থী-তালিকা ঘোষণা না-করে নানা ভাবে গরমিল যে শুরু হয়ে গিয়েছে, নথিপত্র যাচাইয়ের জন্য ‘নট এমপ্যানেলড’ প্রার্থীদেরও ডাক পাঠানোর ঘটনায় সেটা স্পষ্ট।
এ ক্ষেত্রে পর্ষদের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন খোদ শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সোমবার বিধানসভায় নিজের ঘরে বসে তিনি বলেন, ‘‘মেধা-তালিকা তো ও-ভাবে হয় না। সিপিএম আমলে এটাও থাকত না। তখন তো তালিকা থাকত আলিমুদ্দিনে। আসল ব্যাপারটা হল ভেরিফিকেশন। নথিপত্র যাচাই।’’ সেই ভেরিফিকেশনেই গরমিলের ভূত নৃত্য করতে পারে বলে আশঙ্কা শিক্ষা শিবিরের একাংশের।
সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় পর্ষদের দু’টি ওয়েবসাইটের ছবি এবং একটি তালিকার এক ছবিকে ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়েছে। তিনটি ছবিতেই দেখা যাচ্ছে, পর্ষদের ওয়েবসাইটে আলিপুরদুয়ারের বিশ্বজিৎ বর্মন এবং পূর্ব মেদিনীপুরের প্রলয় সরকারের নামের পাশে ‘নট এমপ্যানেলড’ লেখা থাকা সত্ত্বেও তাঁরা পর্ষদে নথি যাচাইয়ের জন্য ডাক পেয়েছেন। সঙ্গে রয়েছে আরও ৪০ জনের তালিকা।
এটা সম্ভব হচ্ছে কী ভাবে?
গরমিলের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে পর্ষদের সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য জানান, শুধু ওই দু’জন নন। গোটা রাজ্যে এ-রকম প্রায় ১৫০ জনের হদিস মিলেছে, যাঁরা প্রশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও গত অক্টোবরে ইন্টারভিউয়ে প্রামাণ্য নথি দেখাতে পারেননি। তাই আবার তাঁদের ডাকা হয়েছে।
বিশ্বজিৎ ও প্রলয়ের বিষয়ে পর্ষদ-প্রধান জানান, ওই দু’জনই ২০০৫ সালের ‘প্রাইমারি টিচার ট্রেনিং’ বা পিটিটি পাশ করেছেন। কিন্তু পরে সুপ্রিম কোর্ট এবং ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর টিচার এডুকেশন বা এনসিটিই-র নির্দেশ অনুসারে তা অবৈধ হয়ে যায়। পরিবর্তে ডিপ্লোমা ইন এলিমেন্টারি এডুকেশন বা ডিএলএড বাধ্যতামূলক করা হয়। অবশ্য যাঁদের পিটিটি প্রশিক্ষণ রয়েছে, তাঁরা রাজ্য সরকারের অধীনে এক বছরের ব্রিজ কোর্স করলে সেটা ডিএলএড প্রশিক্ষণের সমতুল হিসেবে গণ্য করা হয়। নিজেদের প্রশিক্ষিত হিসেবে প্রমাণ করতে হলে পিটিটি এবং ব্রিজ কোর্স দু’টিরই শংসাপত্র পেশ করা বাধ্যতামূলক। মানিকবাবুর বক্তব্য, গত ১৪ সেপ্টেম্বর টেটের ফল প্রকাশের পরে ২৬ অক্টোবর ইন্টারভিউয়ের সময় শুধু ব্রিজ কোর্সের শংসাপত্র দেখানোয় ওই দুই প্রার্থীকে ‘নট এমপ্যানেলড’ করে দেওয়া হয়। কিন্তু গোল বাধে গত ৩১ জানুয়ারি প্রার্থী-তালিকা ঘোষণার পরে। ওই দুই প্রার্থী পর্ষদের ওয়েবসাইটে দেখেন, প্রশিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের নামের পাশে ‘নট এমপ্যানেলড’ লেখা হয়েছে। পর্ষদে যোগাযোগ করেন তাঁরা। বিক্ষোভও হয় পর্ষদের অফিসের সামনে। মানিকবাবু বলেন, ‘‘তখন ওঁদের কিছু প্রামাণ্য নথি দেখতে চাওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট বিভাগ তা খতিয়ে দেখে বুঝতে পারে, ওই দুই প্রার্থী অক্টোবরে পিটিটি-র শংসাপত্র জমাই দেননি। আর সেই জন্যই ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁদের ডাকা হয়েছে।’’
অল বেঙ্গল সেভ এডুকেশন কমিটির তরফে কার্তিক সাহা বলেন, ‘‘সকলের প্রতি সহানুভূতি রেখেই বলছি, রহস্যের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে এখানেই। যদি প্রার্থী-তালিকা চূড়ান্ত হয়ে গিয়ে থাকে, তা হলে এঁদের কী ভাবে নিয়োগপত্র দেওয়া সম্ভব?’’
এই প্রশ্নের সরাসরি কোনও উত্তর দেননি মানিকবাবু। তিনি বলেন, ‘‘সরকারকে জানাব। তার পরে যা নিয়ম রয়েছে, তা-ই করা হবে।’’ পর্ষদের দাবি, প্রায় ১১ হাজার ৩০০ জন প্রশিক্ষিত প্রার্থীর নিয়োগ হয়ে গিয়েছে। আর শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘প্রাথমিকে ৪২ হাজার ৪০০ শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে। এই মাসেই পুরো কাজ শেষ হয়ে যাবে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষক নিয়োগ ১৫ মার্চের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছি। সব মিলিয়ে ৭২ হাজার শিক্ষক নিয়োগ হবে।’’ বারবার মামলা করে কর্মপ্রার্থীদের যাতে বিপদে ফেলা না-হয়, সেই আবেদন জানান মন্ত্রী।