ছবি: সংগৃহীত।
খোদ মুখ্যমন্ত্রী ডেঙ্গির বাড়বাড়ন্তের জন্য প্রশাসনিক শিথিলতাকে দায়ী করেছেন। তা সত্ত্বেও প্রশাসনের একটা মহল থেকে ফের তথ্য গোপন করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ। যে-সব হাসপাতালে ইতিমধ্যেই ডেঙ্গি রোগীদের মৃত্যু হয়েছে, সেখানে একাধিক ক্ষেত্রে হাসপাতাল বা সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের দায়িত্বপালন নিয়ে পাল্টা প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি সব মহলেই ডেঙ্গির তথ্য প্রকাশ নিয়ে আবার ঢাকঢাক-গুড়গুড় শুরু হয়েছে।
অথচ সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসকদের অনেকেই জানিয়েছেন, আগে যাঁদের ডেঙ্গি হয়ে গিয়েছে, তাঁদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বার ডেঙ্গি হলে ঝুঁকি বহু গুণ বেশি। কারণ, দ্বিতীয় বারের ডেঙ্গি এক ধাক্কায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গকে বিকল করে দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, সমস্যা হল, আগে যে ডেঙ্গি হয়েছিল, একাধিক ক্ষেত্রে সেই তথ্য রোগী বা তাঁদের পরিবারের কাছে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বহু ক্ষেত্রে দু’তিন দিনের জ্বর এবং তার মধ্যেই সব শেষ। হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করার পরেও শেষরক্ষা হচ্ছে না।
কেন আগের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না? এক চিকিৎসকের কথায়, ‘‘এর দু’টি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, ডেঙ্গি যে হয়েছে তা রোগী আগের বার বোঝেননি। সাধারণ জ্বরের মতোই তা কমে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এর আগে একাধিক বছরেই ডেঙ্গির তথ্য প্রকাশ নিয়ে মুখ বন্ধ রাখার প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি ছিল। ফলে কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত রিপোর্ট সামনে আসেনি।’’
ডেঙ্গি পরীক্ষায়
• আইজিজি অর্থাৎ ইমিউনোগ্লোবিউলিন জি অ্যান্টিবডির পরীক্ষায় বোঝা যায়, অতীতে সেই ব্যক্তির ডেঙ্গি হয়েছে কি না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকাতেও ডেঙ্গি নির্ণায়ক আইজিএম (ইমিউনোগ্লোবিউলিন এম) পরীক্ষার পাশাপাশি আইজিজি পরীক্ষার গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। আইজিএম পরীক্ষায় বর্তমানে
ডেঙ্গি হয়েছে কি না, তা বোঝা যায়।
এ ক্ষেত্রে রক্তের আইজিজি পরীক্ষার (ইমিউনোগ্লোবিউলিন জি অ্যান্টিবডির পরীক্ষা) উপরে জোর দিয়েছেন কেউ কেউ। কারণ, আইজিজি পরীক্ষা করলে শরীরে আগে থেকেই ডেঙ্গির জীবাণু রয়েছে কি না, তা বোঝা যায়। প্রবীণ প্যাথোলজিস্ট সুবীর দত্তের কথায়, ‘‘আইজিজি এবং আইজিএম দু’টিই পজিটিভ হওয়ার অর্থ, সেই ব্যক্তি অতীতে ডেঙ্গি আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং বর্তমানে ফের তিনি ডেঙ্গির শিকার।’’ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক অরুণাংশু তালুকদার বলেন, ‘‘আগে ডেঙ্গি হলে সেই রোগীকে অনেক বেশি নজরদারিতে রাখা জরুরি। অন্য ক্ষেত্রে প্রতিদিন রক্ত পরীক্ষা করতে হলেও দ্বিতীয় বার ডেঙ্গির ক্ষেত্রে দিনে দু’বার তা করা প্রয়োজন। শরীরের প্রতিটি অঙ্গের দিকে নজর রাখা জরুরি। যাতে কোনও অঙ্গে সামান্য সমস্যা হলেই ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’’
আরও পড়ুন: উত্তরে খুশি ‘ম্যাডাম’, স্বস্তিতে ওঁরাও
শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষও জানিয়েছেন, দ্বিতীয় বারের ডেঙ্গি অনেক বেশি শক্তি নিয়ে আক্রমণ করছে। তিনি বলেন, ‘‘ডেঙ্গি আক্রান্ত হওয়ার পরে শরীর রোগের সঙ্গে লড়াই করছে না, বরং বিকল হচ্ছে একাধিক অঙ্গ। চিকিৎসার পরিভাষায়—ডেঙ্গি উইথ হিমোফ্যাগোসাইটিক লিম্ফোহিস্টিওসাইটোসিস (এইচএলএইচ)। রোগের আনুপূর্বিক বৃত্তান্ত জানা তাই খুব জরুরি।’’ এই পরিস্থিতিতে চিকিৎসকদের অনেকেই ফের সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। যেমন, ২০১৭-য় ডেঙ্গি রাজ্যে ভয়াবহ আকার নিলেও রোগ নির্ণয় তো বটেই, ডেথ সার্টিফিকেটেও ডেঙ্গি না লেখার অলিখিত নির্দেশ পৌঁছেছিল বিভিন্ন হাসপাতালে। কলকাতার এক মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকের কথায়, ‘‘খোদ মুখ্যমন্ত্রী যেখানে স্বীকার করেছেন, আরও আগে সতর্ক হলে মৃত্যুর ঘটনা এড়ানো যেত, সেখানে নীচের স্তরে এই গোপন করার প্রবণতা অবাক করার মতো। যে ভাবে ওঁরা চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করেছেন, তাতে বহু ডাক্তার এবং হাসপাতাল ডেঙ্গি রোগীর চিকিৎসা করার আগে দু’বার ভাববেন।’’
অথচ রাজ্যের বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, এ বছরের গোড়ায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও গত কয়েক সপ্তাহে অত্যন্ত খারাপ ধরনের ডেঙ্গির রোগী আসতে শুরু করেছেন। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘যাঁদের আগে থেকেই ডায়াবিটিস বা হাইপার টেনশন, হার্ট বা কিডনির সমস্যা রয়েছে, তাঁদের অনেকেই অসুখটা সামলে উঠতে পারছে না। একে বলা হয় ‘কো মরবিড কন্ডিশন’। এটাই ভাবাচ্ছে আমাদের।’’
তা হলে পরিস্থিতিকে অস্বীকার করার প্রবণতা কেন? স্বাস্থ্য দফতরের এক আধিকারিকের জবাব, ‘‘এর উত্তরে আপাতত নীরবতাই শ্রেয়।’’ তা হলে কি তাঁদের কাছেও মুখ না খোলার ‘নির্দেশ’ এসেছে?
উত্তরে তিনি মৌনী ছিলেন।