—প্রতীকী ছবি।
রোগী ডায়ারিয়ায় ভুগছেন। টেলিমেডিসিন প্রক্রিয়ায় তাঁকে দেখে চিকিৎসক ব্লাড কালচার টেস্ট, ইসিজি, ইউএসজি, মল এবং করোনা পরীক্ষা করতে দিয়েছেন! সাধারণ ডায়ারিয়ার সঙ্গে ইসিজি, ইউএসজি বা রক্তের কালচার রিপোর্টের কী সম্পর্ক, তা স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদেরও বোধগম্য হয়নি। সতর্ক করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসককে।
গ্রামাঞ্চলের রোগীদের জন্য রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের টেলিমেডিসিন চিকিৎসায় এই রকম ভুরি ভুরি অপ্রাসঙ্গিক, ভুল চিকিৎসা, ভুল ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ এবং টেস্টের অভিযোগ উঠেছে। প্রচুর প্রেসক্রিপশনে নিয়ম ভেঙে জেনারিকের বদলে ব্র্যান্ড নেমের ওষুধ লেখার অভিযোগ উঠেছে সরকারি চিকিৎসকের বিরুদ্ধে।
রাজ্যের টেলিমেডিসিন নোডাল অফিসার নিতাইচন্দ্র মণ্ডলের কথায়, ‘‘এটা অনভিপ্রেত এবং দুঃখজনক। কিছু চিকিৎসক টেলিমেডিসিন প্রক্রিয়ায় ভুলভ্রান্তি করছেন। ব্র্যান্ড নেমও লিখছেন। কেন লিখছেন বুঝতে পারছি না। ওই চিকিৎসক এবং প্রেসক্রিপশনগুলিকে চিহ্নিত করার কাজ চলছে। জেলাগুলিকে নিয়ে দ্রুত বৈঠক হবে।’’
তিন বছর আগে টেলিমেডিসিন পরিষেবা চালু করেছে স্বাস্থ্য দফতর। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসকের অভাব মেটাতেই এই ব্যবস্থা। সুস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কমিউনিটি হেলথ অফিসারের উপস্থিতিতে ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীকে যুক্ত করা হয়। অনলাইনে রোগী দেখে চিকিৎসক অনলাইনেই প্রেসক্রিপশন পাঠান।
গত ৪ জানুয়ারি উত্তর দিনাজপুরের করণদিঘির এক রোগিনীকে টেলিমেডিসিন প্রক্রিয়ায় দেখেন নদিয়ার কৃষ্ণনগরের এক চিকিৎসক। অভিযোগ, ডায়ারিয়ায় আক্রান্ত সেই রোগিনীকে ছ’ধরনের ব্র্যান্ড নেমের ওষুধ দিয়ে ইসিজি, ইউএসজি, ব্লাড কালচার, করোনা পরীক্ষাও করাতে বলেন চিকিৎসক। তাঁকে কোনও মেডিক্যাল কলেজে গ্যাসট্রোএন্টারোলজি আউটডোরেও যেতে বলেন। ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত স্বাস্থ্যকর্তারাই জানাচ্ছেন, ডায়ারিয়ার ‘ক্লাসিক’ চিকিৎসা হল ওআরএস, প্রচুর জলীয় খাবার এবং বিশ্রাম। সেই জায়গায় এমন ‘ভয়ানক’ চিকিৎসার বহর তাঁদেরও স্তম্ভিত করেছে।
অভিযোগ, ২৪ জানুয়ারি হাঁটুর ব্যথায় জেরবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৭২ বছরের এক বৃদ্ধকে বাঁকুড়ার এক চিকিৎসক হজমের ওষুধ দেন, সেটাও আবার ব্র্যান্ড নেম! হাঁটুর ব্যাথা নিয়ে আসা দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৬০ বছরের এক রোগিনীকে টেলিমেডিসিনে শুধু ফিজিওথেরাপি করানোর পরামর্শ দিয়েছেন ডায়মন্ড বারবারের এক চিকিৎসক। প্রত্যন্ত গ্রামের ওই রোগীর প্রশ্ন, ‘‘ও সব তো আমাদের গ্রামে হয় না। অত টাকা পয়সাও আমাদের
নেই। এখন কোথায় যাব? সরকারি জায়গা থেকে ওষুধ না পেলে এই ব্যবস্থার অর্থ কী?’’
৩১ জানুয়ারি দক্ষিণ ২৪ পরগনার নৈনানপুর কেন্দ্রে ২ মাসের এক শিশুকে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ডায়মন্ড হারবারের এক চিকিৎসক প্রাপ্তবয়স্কদের ওষুধ লিখেছেন এবং সেটাও ব্র্যান্ড নেমে! অভিযোগ, এই রকম ভ্রান্তিকর ও ভুলে ভরা প্রেসক্রিপশনের পাহাড় জমছে টেলিমেডিসিনে।
টেলিমেডিসিন পরিষেবার চিকিৎসকদের একাংশের অভিযোগ, রুটিন ডিউটির পরে যখন-তখন তাঁদের টেলিমেডিসিনে লগ-ইন করতে বলা হয়। দিনে ৬৫-৭০ জন রোগীকে অনলাইনে দেখতে হয়। তাঁরা ক্লান্ত হয়ে যান। এ ভাবে কখনও ভাল পরিষেবা দেওয়া যায় না। তাঁদের দাবি, দায়সারা কাজের ফলেই ভুলভ্রান্তি হচ্ছে।
স্বাস্থ্য দফতরের কিছু কর্তা আবার জানিয়েছেন, ২০২৩ সালের ২৬ জুলাই কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক একটি নির্দেশ জারি করে জানায়, সুস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কমিউনিটি হেলথ অফিসারদের অনেকেই আয়ুষ চিকিৎসক। তাঁদের জন্য আয়ুষের ওষুধ সরবরাহ করলে তাঁরাই ওই কেন্দ্রে হাতেকলমে রোগী দেখে ওষুধ দিতে পারেন। কিন্তু সেই ব্যবস্থা এ রাজ্যে করা হয়নি। ফলে আয়ুষ চিকিৎসকেরা ওই কেন্দ্রে থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসা করতে পারছেন না, আর টেলিমেডিসিন পরিষেবায় অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা দিতে গিয়ে বহু ক্ষেত্রে গুরুতর ত্রুটি থেকে যাচ্ছে।