লজ্জায় আর বাড়ি ফিরতে চায় না কিশোরী

এখন যে সন্ধে নামে তাড়াতাড়ি, তাতেই স্বস্তি পায় ময়নাগুড়ির এক কিশোরী। ত্রয়োদশী মেয়েটির মুখে ফুলঝুরি ছুটত এক সময়। এখন কথা বলতে গেলেই কুঁকড়ে যায়।

Advertisement

পার্থ চক্রবর্তী ও দীপঙ্কর ঘটক

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৫০
Share:

মামার বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করছে ময়নাগুড়ির কিশোরী।—নিজস্ব চিত্র

এখন যে সন্ধে নামে তাড়াতাড়ি, তাতেই স্বস্তি পায় ময়নাগুড়ির এক কিশোরী।

Advertisement

ত্রয়োদশী মেয়েটির মুখে ফুলঝুরি ছুটত এক সময়। এখন কথা বলতে গেলেই কুঁকড়ে যায়। আড়াল খোঁজে। শীতের সকালে রোদের মধ্যে উঠোনে বসে থাকতে থাকতে, হঠাৎ কাউকে ঢুকতে দেখলে চকিতে উঠে যায়। ঘরের পাশ ঘেঁষা বেঞ্চটিতে গিয়ে বসে। দিনের আলোয় বাইরে বেরোতে চায় না। সন্ধে নামলে খুশি হয়।

১১ নভেম্বর থেকে তার জীবনটাই বদলে গিয়েছে। সে দিন এক প্রতিবেশী ত্রয়োদশী এই কিশোরীকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। জানাজানিও হয়ে যায়। পাড়ায় বেরোনো বন্ধ তখন থেকেই। সামনে পরীক্ষা ছিল। দিতে পারেনি। সে যে পরীক্ষায় বসতে পারবে না, সে কথা গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান একটি সার্টিফিকেটেও লিখে দিয়েছেন৷ যাতে লেখা রয়েছে মেয়েটি ‘ধর্ষণের শিকার’। তাতেই সারা গ্রামে আরও ছড়িয়ে যায়। তখনই বাড়ি ছেড়ে মামার বাড়িতে চলে আসে ওই কিশোরী। পঞ্চায়েত প্রধান এখন হাত কামড়াচ্ছেন। বলছেন, ‘‘মেয়েটার ভাল করতে গিয়ে খারাপ করে দিলাম।’’

Advertisement

এখন সেই কিশোরী সারা ক্ষণ মুখ নিচু করে থাকে। অভিযুক্তেরা যে ধরা পড়েনি, তারা যে তার বাড়িতে হুমকি দিচ্ছে, সে খবর সে রাখে। তাতে তার ব্যথা বাড়ে। কিন্তু মুখ ফুটে শুধু বলতে পারে, ‘‘আমি আর পাড়াতেই যাব না।’’ শুধু পাড়া নয়। সে স্কুলেও আর যেতে চায় না। সবাই যে জেনে গিয়েছে। তার দাদু বলেন, ‘‘সামাজিক ভাবে ওর যে চরিত্রহনন হয়েছে, সে কথা ও বোঝে। লজ্জা পায়।’’ সেই লজ্জা থেকেই বাঁচতে পাড়ায় ফিরতে চায় না। তা ছাড়া, অভিযুক্তেরা প্রাণে মারার হুমকিও দিচ্ছে। তাই দাদুর বাড়়ির কাছেই নতুন কোনও স্কুলে ভর্তি হতে চায়। মেয়েটির মা-ও এ দিন বলেন, ‘‘মেয়ে বলে দিয়েছে, বাড়িতে নিয়ে এলে সে আত্মহত্যা করবে৷ তাই জোর করছি না৷’’

মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘মেয়েটি চাইছে ওই স্মৃতির অনুষজ্ঞ থেকে দূরে থাকতে। তাকে এখন বোঝানো দরকার, লজ্জাটা তার নয়, যে দোষ করেছে তার।’’

তার পরিবার সেই চেষ্টা করছে। তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন সকলেই। পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জলপাইগুড়ির পুলিশ সুপার অবশ্য জানিয়েছেন, সব অভিযোগই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কেউ ভুল করলে তাঁকে ছাড়া হবে না। যদিও এই আশ্বাসের পরেও ময়নাগুড়ির থানা মেয়েটির বাড়ির লোকেদের অভিযোগের ‘রিসিভড কপি’ দেয়নি। যত এই সব খবর ওই কিশোরীর কানে পৌঁছয়, ততই আরও গুটিয়ে যায় সে।

কিন্তু কিশোরীর দিদিমার কথায়, ‘‘হাসিখুশি সরল মেয়েটি এক ধাক্কায় বড় হয়ে গিয়েছে।’’ কিন্তু এ রকম ভাবে বড় হতে সে চায়নি। এখনও সে কেউ না থাকলে জানলার দিকে মুখ করে বসে পাঠ্য বই থেকেই জসীমুদ্দিন পড়ে—‘মেলি বাম পাশে দুটি পাও তাতে মেহেদীর রঙ ভরা।...ছেলেটি সেদিক অনিমেষ চেয়ে, মেয়েটি পাইয়া টের, শাড়ির আঁচলে চরণ দুইটি ঢাকিয়া লইল ফের।’

হুমকি, আটক অভিযুক্তের বাবা

ধর্ষিতা কিশোরীর বাড়িতে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে মূল অভিযুক্তর বাবাকে শুক্রবার আটক করল ময়নাগুড়ি থানার পুলিশ৷ তবে এ দিন দুপুরে ওই কিশোরীর বাবা ময়নাগুড়ি থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও, গভীর রাত পর্যন্ত তাঁকে কোনও ‘রিসিভড কপি’ দেওয়া হয়নি বলে দাবি৷ তবে ময়নাগুড়ি থানার আধিকারিকদের যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরা ফোন ধরেননি৷ গত ১১ নভেম্বর ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ৷ কিশোরীর বাবা জানান, অভিযুক্তেরা তাঁদের হুমকি দিচ্ছে বলে নালিশ করেছেন তিনি। তবে তিনি বলেন, রিসিভ কপি না দিলেও রাতে পুলিশ গ্রামে এসে অভিযুক্তর বাবাকে থানায় নিয়ে যায় ৷

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement