প্রতীকী ছবি।
‘আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি মাস্টারমশাই’!
প্রয়াত পরিচালক তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ সিনেমায় এই ঠান্ডা হুমকিটা মনে আছে? ‘রিল’ হোক বা ‘রিয়াল’, কখনও কখনও এমন হুমকির মুখে পড়তে হয় বহু মাস্টারমশাই কিংবা দিদিমণিকে! কিন্তু মুশকিলটা হল, তাঁরা সবই দেখেন। দেখতে পান। আবার দেখাতে শেখানও!
১৫ অগস্টের সকাল। স্কুলে প্রথমে বন্দে মাতরম্ হবে। তার পরে দু’টো করে শেফালি লজেন্স। স্কুল ছুটি। কিন্তু গোল বাধল প্রেয়ার লাইনে। মাস্টারমশাইরা বললেন— বন্দে মাতরম্...। সকলেই সমস্বরে তা ফিরিয়ে দিল। কিন্তু আমরা কয়েক জন বললাম— আলু খেয়ে পেট গরম।
নিছক প্রাইমারিবেলার দুষ্টুমি। কিন্তু খালেক স্যর শুনবেন কেন? তাঁর কান ও মেজাজ দুটোই গরম হয়ে গিয়েছে। প্রেয়ার লাইনে দাঁড় করিয়ে শুরু হল বেদম মার। প্রথমে লিকলিকে কঞ্চি। তার পর হাতের তেলো। হাত-পিঠ-কান জ্বলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, এক ছুটে পালিয়ে যাই। কিন্তু সেই অবস্থাতেই কাঁদতে কাঁদতে আমাদের বলতে হল— বন্দে মাতরম্। এক বার, দু’বার নয়, টানা দশ বার।
বিকেলে খালেক স্যর বাড়িতে এলেন। পরম মমতায় মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘খুব লেগেছে না রে? শোন, মা আর দেশ দু’টোই সমার্থক। তাদের অপমান করতে নেই। অপমান সহ্যও করতে নেই।’
বিরাট কিছু যে বুঝেছিলাম, এমন নয়। কিন্তু স্যরের কথা শুনে কেঁদে ফেলেছিলাম। এখনও ১৫ অগস্ট তো বটেই, অন্য কোনও সময় ‘বন্দে মাতরম্’ শুনলেই খালেক স্যরের মুখটাই আগে মনে পড়ে।
৫ সেপ্টেম্বরের এক সকাল। মঞ্চে প্রধানশিক্ষক স্বামী দেবরাজানন্দ মহারাজ। আমরা সামনে বসে আছি। মহারাজ বললেন, ‘এই পৃথিবীতে কেউ যদি তোমাকে একটা অক্ষরও শেখান, তিনিই শিক্ষক।’ আরও অনেক কথা তিনি বলেছিলেন। কিন্তু ওই একটা কথাই তখন আমি ভেবে চলেছি। মনে মনে গুনে দেখছি, এ বাবা ক্লাস সিক্সে উঠতে না উঠতেই আমার এত্ত শিক্ষক!
প্রথম শিক্ষক আমার মা। গ্রামের স্কুলের শিক্ষকেরা তো আছেনই। তারপর বনমালী জেঠা, বাবলু দাদা, নইমুদ্দিন চাচা, মাধু পিসি— সে লিস্টি এখনও বেড়ে চলেছে। ওঁরা সকলেই কিছু না কিছু শিখিয়েছেন, শেখাচ্ছেন। মহারাজের ওই একটা কথাতেই আমার গোবরে ঠাসা মাথাতেও একটা বিদ্যুৎ খেলে গিয়েছিল সে দিন!
বরফ গলে জল হয়। জানতাম। কিন্তু জটিল সব সম্পাদ্য, উপপাদ্য, বীজগণিত, পাটিগণিতও জলের মতো হতে পারে?
মানিকবাবু মুচকি হেসে বলেছিলেন, ‘আলবাত পারে। শুধু অঙ্কটাকে একটু ভালবাসতে হবে বাবা।’ ক্লাস এইট থেকে নাইনে ওঠার সময় অঙ্কে ১০০-এর মধ্যে ৪ (ছাপার ভুল নয়) পাওয়ার পরে বাড়িতে এক রাউন্ড ঐতিহাসিক যাত্রাপালা হয়েছিল। তার পরে ভাল না বেসে আর উপায় আছে? সত্যি বলতে অঙ্ক আজও আমার কাছে জলের মতো মনে হয় না। কিন্তু বরফ গলেছিল। মাধ্যমিকে ৬২। আজও বিশ্বাস করি, ওই নম্বরটার পিছনে আমার কোনও কৃতিত্ব নেই।
পাঠকবাবু কিটসের কবিতা পড়াচ্ছেন। গোটা ক্লাসে পিন পড়ার স্তব্ধতা। কোথায় কোথায় স্যর হারিয়ে যাচ্ছেন। আমিও ভেসে ভেসে যাচ্ছি। ইংরেজিটা আজও শিখতে পারলাম না। কিন্তু ওই হারিয়ে যাওয়া, ওই মনকেমন... আহা...
মুখের উপর বলেছিলাম, ‘এ আমার দ্বারা হবে না।’ দূর্বাদলবাবু বললেন, ‘আমি বলছি, হবে। সবটা আমিই তোমাকে দেখিয়ে দেব।’ তিনিই লিখতেন, তিনিই পড়তেন, তিনিই দেখাতেন। আমি শুধু বসে থাকতাম। দেখতাম। অন্য ভাবে। অন্য চোখে। তার পর এক দিন সত্যিই হল! গল্প শুনতে শুনতেই পরীক্ষায় পাশ দিয়ে দিলাম! মনে হয়েছিল, দূর্বাদলবাবু নিশ্চয় ম্যাজিক জানেন!
মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা সত্যি সত্যিই ম্যাজিক জানেন!