প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ। এবং প্রকৃতির সঙ্গেই সন্ধি-সমঝোতা!
সাধারণ ভাবে পাহাড়ি ঠান্ডা আবহাওয়াতেই চা ও কফির চাষ হয়। অন্তত সেটাই প্রচলিত ধারণা। এ বার এই দু’টি শস্যেরই চাষ হবে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামের উষ্ণ আবহাওয়ায়। শুষ্ক, রুক্ষ, অনুর্বর জমিতে। এক কথায় চা ও কফি জোগাবে জঙ্গলমহলও।
খড়্গপুর আইআইটি হাতেকলমে পরীক্ষা করে দেখেছে, মেদিনীপুরের আবহাওয়াতেও চা ও কফির চাষ সম্ভব। আইআইটি-র কাছে গোপালিতে সফল হয়েছে সেই চাষ। আইআইটি-র কৃষি বিভাগের সেই প্রযুক্তি নিয়েই রাজ্য সরকার এ বার নামছে জঙ্গলমহলে। চাষ করবে মূলত গ্রাম পঞ্চায়েত। টাকা ও লোকবল জোগাবে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প। জলপাইগুড়ি দিচ্ছে চা-গাছের চারা। কফির চারা জোগাচ্ছে মংপু।
এই প্রকল্পের মাধ্যমে এক ঢিলে দুই পাখি মারার চেষ্টা করছে রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর। প্রথমত, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প থেকেই নেওয়া হবে চা ও কফি চাষের শ্রমিক। ফলে জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকায় অসংখ্য মানুষের নিয়মিত রোজগারের পথ সুগম হবে। এক সময় আর্থিক বঞ্চনা, বেকারত্ব ও পুলিশি অত্যাচারকে সামনে রেখে ওই এলাকায় মাওবাদী আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। সেই আন্দোলন এখন স্তিমিত। উন্নয়ন হয়েছে জঙ্গলমহল জুড়ে। এ বার সেখানেই হবে চা ও কফির চাষ। সংস্থান হবে রুজির।
দ্বিতীয়ত, জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ রুক্ষ জমি চাষের অযোগ্য বলে এত দিন উপেক্ষিত হয়েছে। আইআইটি-র প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সেখানে চা ও কফির চাষ শুরু হলে সেই জমির অহল্যা অপবাদ ঘুচবে। রাজ্যে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প দেখভালের দায়িত্বে থাকা কমিশনার, আইএএস অফিসার দিব্যেন্দু সরকার জানান, জঙ্গলমহলের রুক্ষ জমিতে আলফানসো আম, বেদানা, অলিভ, আপেলের চাষ শুরু হয়েছে আগেই। এ বার হবে চা-কফি। ‘‘প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা বিজ্ঞানীদের সাহায্য নিচ্ছি,’’ বলেন দিব্যেন্দুবাবু।
চা-কফি চাষের জন্য ‘ইকো ইয়েস টেকনোলজিস প্রাইভেট লিমিটেড’ নামে একটি সংস্থার সাহায্য নিচ্ছে সরকার। আইআইটি-র কৃষি বিভাগের পরীক্ষা সফল হওয়ার পরে বাণিজ্যিক ভাবে চা-কফি চাষের জন্য আইআইটি-র সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি এন্টারপ্রেনার্স পার্কের সঙ্গে চুক্তি করেছে ইকো ইয়েস সংস্থা।
কিন্তু চা-কফি চাষে পাহাড়ি ঠান্ডা আবহাওয়া ছাড়াও যথেষ্ট বৃষ্টির প্রয়োজন। সেটা কী করে সম্ভব?
আইআইটি-র কৃষি বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র-গবেষক এবং ইকো ইয়েস সংস্থার প্রধান সৌমেন পালিত জানান, জঙ্গলমহলের মাটি পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, অনায়াসে চা-কফির চাষ হতে পারে সেখানে। সর্বোচ্চ ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় চা-কফির চাষ হতে পারে। ‘‘পাহাড়ে এক হেক্টর জমিতে ৭৫টি শিরীষ গাছ লাগিয়ে ছায়া তৈরি করা হয়। এখানে সমপরিমাণ জমিতে ১৫০টি শিরীষ গাছ লাগানো হচ্ছে। তারা দেবে ছায়া। তা ছাড়া এখন আর বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে চাষ হয় না। জমিতেই ‘স্প্রিঙ্কলার্স’ (জলের ঘূর্ণি যন্ত্র) বসিয়ে কৃত্রিম সেচের প্রক্রিয়ায় জল জোগানো হয়। এখানেও তা-ই করা হবে,’’ বলছেন সৌমেনবাবু।
প্রধানত গ্রিন-টি তৈরি হবে জঙ্গলমহলে। যন্ত্রে নয়, সেই চা প্রসেসিং করা হবে হাতে হাতে। তার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে স্থানীয় বাসিন্দাদের। চা-কফির মার্কেটিংয়ের দায়িত্ব নেবে সৌমেনবাবুর সংস্থা।