এমনই নানা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে রবীন্দ্রসাহিত্য। নিজস্ব চিত্র।
গীতাঞ্জলির একটি গানের প্রথম চরণটি উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক সাতটি ভাষায় কী ভাবে অনূদিত হয়েছে, প্রথমেই তা দেখা যাক। বাংলা চরণ: ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।’
ধীমাল ভাষায়: ‘যদি নাংকো কাইকাতা হিংতেং হাসুবু মালোনু কলা একলাং হানে রে।’
নেপালি: ‘যদি তিমরো ডাক শুনে কোহী না আয়ে একলই অঘি বড়।’
বোড়ো: ‘নৌ লিংহরনায় রাওঅও মানসিফ্রা রাওঠা রাওঠাব্লা থু হার্সিঙৈনৌ থু।’
মগর: ‘ইস ঙৌ ঢুট ঙাঙোকী কাট লাম লুমনে।’
রাজবংশী: ‘যুদি তোর হামেয়াই কাহো না শুনিল পায় তাহলে চল রে একেলায়।’
রাভা: ‘নিনি কালাঙি সাগসা ফৈ+ চারৈন।’
সাদরি: ‘যুদি তোর বলালনে কেহ না আওয়ে হলে একলে হিঁথ।’
বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গী রবীন্দ্র-সাহিত্য এই ভাবে অনুবাদকর্মের মধ্য দিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের প্রান্তিক ভাষাগোষ্ঠীর দরবারে। জার্মান, ফরাসি, জাপানি, স্প্যানিশ ভাষায় আমরা রবীন্দ্রসাহিত্যের কোথায় অনুবাদ হচ্ছে জানতে উৎসুক। কিন্তু এ বঙ্গেরই বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক ভাষায় রবীন্দ্ররচনার বিচিত্র বিবিধ যে অনুবাদ হচ্ছে, আমরা তার কতটুকু খবর রাখি? বিশ্বসভায় তিনি তো আছেনই, একেবারে প্রত্যন্ত এই সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি যে কতটা আদরণীয় তার উজ্জ্বল প্রমাণ এই অনুবাদগুলি। বস্তুতপক্ষে ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ সূত্রেই এই অনুবাদ-কর্মগুলি যেন একেকটি শিশিরবিন্দু। আঞ্চলিক ভাষার মূলত প্রতিনিধিস্থানীয় লেখকদের সৃজনক্ষমতার ফসল এই অনুবাদগুলি। সেই তালিকায় রয়েছে গীতাঞ্জলির গান, কবিতা, গল্পগুচ্ছের গল্প, নাটক।
নেপালি ভাষায় গীতাঞ্জলির প্রথম অনুবাদকের নাম শঙ্করদেব পণ্ডা। প্রকাশ ১৯৩৬। এ যাবৎ নেপালি ভাষায় গীতাঞ্জলির অনুবাদের সংখ্যাই সর্বাধিক। রেমিকা থাপা অনূদিত গীতাঞ্জলির সর্বশেষ অনুবাদটি প্রকাশিত হয় ২০১০-এ। সাদরি ভাষায় গীতাঞ্জলির গ্রন্থনাম ‘গিতেক ডালি’। অনুবাদক নেহরু ওঁরাও। অনুবাদ হয়েছে লেপচা, বোড়ো, মগর ভাষাতেও। কেউ হিন্দি অনুবাদের সাহায্য নিয়েছেন, আবার কারও দাবি, মূল বাংলা থেকেই সরাসরি আক্ষরিক অনুবাদ করেছেন। সাদরি এবং মগর ভাষায় গীতাঞ্জলির অনুবাদক নেহরু ওঁরাও এবং জীবন রাণার কথায়, ‘‘বাংলায় এমন বহু শব্দ রয়েছে, অনুবাদ করার সময় দেখেছি যেগুলির উপযুক্ত প্রতিশব্দ সাদরি কিংবা মগর ভাষায় নেই। তাই এ ক্ষেত্রে ভাবানুবাদের সাহায্য নেওয়া হয়েছে।’’
হরিপদ রায়ের অনুবাদে রাজবংশী ভাষায় গল্পগুচ্ছের নির্বাচিত পাঁচটি গল্পের সংকলনের নাম ‘গল্ফর ঝপা’। গল্পগুচ্ছের বাছাই করা বারোটি গল্পকে রাজবংশী ভাষায় অনুবাদ করেছেন মিনতি রায়। গ্রন্থের নাম ‘গল্প গোটো’। ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ নেপালি লেখক কর্ণ থামির কলমে অনূদিত হয়ে ‘ফারাকের আসকো ছোঁড়া’। নেপালী ভাষা-সাহিত্যের অন্যতম সারথি পরশমণি প্রধান অনুবাদ করেছেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’। আঞ্চলিক ভাষায় রবীন্দ্র-নাটকের অনুবাদের উল্লেখযোগ্য সংকলন হয়েছে নেপালি ভাষায়। ডাকঘর, চিত্রাঙ্গদা, মুক্তধারা, রক্তকরবী, বিসর্জন-এর অনুবাদ সূর্যবিক্রম গ্রেওয়ালি, দানিয়েল থালিং, ঘনশ্যাম নেপাল, কৃষ্ণসিংহ মোক্তান প্রমুখের কলম ছুঁয়ে পৌঁছে গেছে নেপালি পাঠকদের হাতে। ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটিকে নেপালি ভাষান্তরে বেতার নাট্যরূপ দিয়েছেন শিবকুমার রাই। মঞ্চ-সফলতা পেয়েছে রাজবংশী ভাষায় নগেন্দ্রনাথ রায়কৃত চণ্ডালিকা অনুবাদটি। রাজবংশী ভাষায় ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি ‘পুরান ভিটা’ নামকরণে নাট্যরূপ পেয়েছে রামেশ্বর রায়ের কলমে।
অনুবাদের এই আয়োজন-অঙ্গনে রয়েছে কবিতাও। রুদ্র ঈশ্বরারী ‘দুই বিঘা জমি’ ও ‘সোনার তরী’ অনুবাদ করেছেন বোড়ো ভাষায়—‘বিঘা নৈহু’ এবং ‘সোনালি নাও’। সাদরিতে ‘বীরপুরুষ’ কবিতাটির শীর্ষনাম ‘বীর আদমি’। অনুবাদ করেছেন হেমলতা বাঘোয়ার। ধীমাল ভাষায় রবীন্দ্র-কবিতা ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’ (হায় রে কাংকো অভাগা দেশ), ‘আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই’ (কা ইস্তুং আসরাতো প্রাণকো প্রাণসং খোদাই), ‘ছোট নদী’ (মিহিকা মোরা) অনূদিত হয়েছে গর্জনকুমার মল্লিকের নিজস্ব উদ্যোগে। রাজবংশীতে ‘নিষ্কৃতি’, ‘ভস্ম’ রবীন্দ্র-কবিতা দুটির অনুবাদক গিরিজাশঙ্কর রায়, প্রেমানন্দ রায়। পরেশচন্দ্র রায় অনূদিত ‘ফাগুন’ কবিতার প্রথম স্তবকের দুটি লাইন—
‘ফাগুনত ফুটিচেত কাঞ্চন ফুল
ডালতে ডালতে পুঞ্জা আমের মহুল।’
কিংবা রাজবংশীতে—
‘দিনের আলো নিভিয়া আসিল
বেলাটা ডুবে ডুবে
দেওয়া ঘিরিয়া মেঘ করিচে
চান্দের লোভে লোভে।’
রুদ্র ঈশ্বরারী জানান, রবীন্দ্র-কবিতার অনুবাদ করতে গিয়ে অনেকগুলো ব্যাপার মাথায় রাখতে হয়েছে, খুবই পরিশ্রমসাধ্য কাজ। বাংলার যথার্থ প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া যায়নি অনেক সময়েই। তাই আক্ষরিক অনুবাদ বা ভাষান্তর নয়, কবি যা বলতে চেয়েছেন হুবহু সেই অর্থটি বজায় রাখার জন্য ভাবানুবাদের আশ্রয় নিতে হয়েছে।
ওকিওয়ামা গোয়াইন গীতাঞ্জলির কবিতাগুলির মধ্যে ৩৬টির অনুবাদ করেছেন মূল বাংলা থেকে নেপালিতে এবং বাদবাকিগুলি ইংরেজি থেকে নেপালিতে অনূদিত। নেপালিতে অনূদিত হয়েছে ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’। অনুবাদে তুলসীবাহাদুর ছেত্রী। এই লেখকেরই নির্বাচিত রবীন্দ্র-কবিতার নেপালি সংকলন গ্রন্থটির নাম ‘সঞ্চয়িকা’। রাভা ভাষায় নৃপেন রাভা অনুবাদ করেছেন ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতাটি (চিবেনেপ চিচা)। পাশাং শেরিং লেপচার উদ্যোগে রবীন্দ্র-কবিতার বেশ কিছু অনুবাদ পৌঁছে গেছে লেপচাভাষী পাঠকের কাছে।