প্রতীকী ছবি।
দু’দশক আগেও এই পৃথিবী অন্য রকম ছিল। তখনও খেজুর গা়ছের নির্বিচারে হত্যা বা গাছের বুক ছেঁচে যত্নে সেরা রস আনতে পটু সিউলিদের আকাল নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল। তবু কিছু নিশ্চয়তা ছিল জীবনে। তখনও সিমলেপাড়ার দোকানের ভেনঘরে ভরা শীতে ‘ছেনা-গুড়ে’র পাক হলে তেতলায় বসেই সুবাস টের পেতেন নকুড় নন্দীর দোকানের বড় কত্তা প্রতীপ নন্দী।
এ যুগেও গুড়, সন্দেশের অভাব নেই। কিন্তু অত দূর থেকে নলেনের সুরভি যেন সে-ভাবে আর উদ্বেল করে না।
দক্ষিণ থেকে উত্তরবঙ্গ— সর্বত্রই শীতের মহার্ঘ্য ফসল নলেন গুড়ের উৎকর্ষ নিয়ে মিষ্টি-স্রষ্টাদের উৎকণ্ঠা বেড়েছে। খাস নকুড় পরিবারের তরুণ কর্তা পার্থ নন্দীই বলছেন, “জগন্নাথের কৃপায় ভাল গুড় এখনও পাচ্ছি, কিন্তু সেরা গুড় সংগ্রাহকদের হাতে রাখা নিয়ে বড্ড কসরত করতে হয়। বাবাদের কম বয়সে দু’একজন বাঁধা গুড় কারবারির সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্কেই সবটা চলত। এখন প্রতিযোগিতার বাজারে অনিশ্চয়তা বেশি। নদিয়ার দেবগ্রামের অন্তত তিন জন গুড় কারবারিকে হাতে রেখে ঘুরিয়ে, ফিরিয়ে ব্যবহার করে নলেনের মান বজায় রাখতে হচ্ছে।”
নলেন গুড়ের রসগোল্লা, রসমালাই, ক্ষীরমোহন বিশারদ দক্ষিণ কলকাতার ‘মিঠাই’য়ের নীলাঞ্জন ঘোষ থেকে বহরমপুরের জয় মা কালী-র সুজিত সাহা বা রিষড়ার ফেলু ময়রার ঘরের অমিতাভ মোদকদেরও এক সুর, মিষ্টি-কারবারিদের এখন সরাসরি গুড় চাষিদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বললেই চলে! মধ্যবর্তী গুড় কারবারি বা মিডলম্যানদের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে। নানা কারণেই এই ব্যবস্থাটা তত নিরাপদ ঠেকছে না। মিষ্টি-স্রষ্টাদের একটি মঞ্চের তরফে মুশকিল আসানের জন্য রাজ্য কৃষি বিপণন দফতরের বিশেষ সচিব অশোককুমার দাসকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তাতে কৃষি বিপণন আধিকারিকদের আশ্বাস, রাজ্য সরকারের ‘সুফল বাংলা’ প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি গুড়-চাষি বা সিউলিদের সঙ্গে মিষ্টি-স্রষ্টাদের যোগাযোগ করিয়ে দিলে সমস্যার সুরাহা হতে পারে। সুফল বাংলার ৩৫১টি বিপণি রাজ্যে ছড়িয়ে। দুক্ষিণবঙ্গে ১০০জন গুড়-চাষি বা সিউলির গুড় তাঁরা নামমাত্র লাভে বিক্রি করেন। এক সরকারি কর্তা বলছেন, “মিষ্টি-স্রষ্টাদের গুড়ের চাহিদা হিসেব করে দরকারে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া বা অন্যত্রও গুড়ের জোগান বাড়াব। চাষিদের ন্যায্য দাম এবং মিষ্টি-স্রষ্টাদের জন্য গুড়ের মানও নিশ্চিত করা হবে।”
মিষ্টি-স্রষ্টারা অবশ্য শুধু গুড় নয়, বছরভর ঘি এবং মধুর জোগানের জন্যও সুফল বাংলা-র সঙ্গে চুক্তিতে আসতে চান। দু’পক্ষই বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে এগোতে আগ্রহী। তবে জয়নগর, বহড়ুর মতো কয়েকটি এলাকায় নলেন গুড় সংগ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ আছে মিষ্টি-কারবারিদের। জয়নগরের পুরনো দোকান শ্রীকৃষ্ণর কর্ত্রী পিয়ালি ঘোষ মাইতির কথায়, “আমরা যাঁর কাছ থেকে গুড় নিই, সেই গোলাম হোসেন মোল্লা নিজে ৬০ পেরিয়েও গাছে চড়েন। তিনি কয়েক জন সহযোগীর সাহায্যে সেরা গুড়ের জোগান নিশ্চিত করেন। ওঁর সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে আমরাও বাড়তি আত্মবিশ্বাস পাই।” তবে পুরনো সিউলিদের জমানা শেষ হতে পরের প্রজন্ম অন্য কাজে ঝুঁকছে। এই সঙ্কটেই হস্তক্ষেপ করছে সুফল বাংলা। সিউলিদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে গুড়ের উৎকর্ষ বজায় রাখতে আরও কিছু বিক্ষিপ্ত উদ্যোগও দেখা যাচ্ছে বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায়। তবে গুড় সংগ্রহ থেকে দোকানে মিষ্টির বিপণন - এই গোটা বাস্তুতন্ত্রটিতে শৃঙ্খলা এখনও দূর অস্ত! ফলে, গাছ এবং গুড় দুয়েরই দফা রফা হচ্ছে। আজকাল মিষ্টির উপাদানের মান নিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা আধিকারিকদের কড়াকড়িও বেড়েছে। চাষিদের কাছ থেকে সরাসরি গুড় পেলে মান নিয়ে অনেকটা নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে মনে করছেন মিষ্টি-স্রষ্টারা।