ফেডারেশনের মাথা থেকে শুভেন্দু অধিকারীর নীরব প্রস্থান ঘটে গেল।—ফাইল চিত্র।
দলে ব্যাপক রদবদল। তার পরে নবগঠিত কমিটির প্রথম বৈঠক। সে বৈঠকে শুভেন্দু অধিকারী কেন অনুপস্থিত? গুঞ্জন তৈরি হয়েছিল তখনই। তার পরে রাজ্য মন্ত্রিসভার একটা বৈঠকেও শুভেন্দুকে দেখা না যাওয়ায় সে গুঞ্জন আরও বাড়ে। গরহাজিরার তালিকায় সাম্প্রতিকতম সংযোজন তৃণমূলের সরকারি কর্মচারী সংগঠনের বৈঠক। আর সে বৈঠকে সংগঠনের দায়িত্ব থেকে নিঃশব্দে যে ভাবে অপসারণ ঘটে গেল রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর, তাতে জল্পনা চতুর্গুণ হয়েছে। তৃণমূলে শুভেন্দুর গুরুত্ব কি কমছে? গোটা রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরে এখন এই প্রশ্ন।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের সাংগঠনিক কাঠামো গত বছরই ঢেলে সাজানো হয়েছিল। তিন জনকে সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। দিব্যেন্দু রায়, সৌম্য ঘোষ এবং তপন গড়াইকে সংগঠনের আহ্বায়ক করা হয়েছিল। একটা কোর কমিটিও গড়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে মূল দায়িত্বে ছিলেন এই তিন নেতাই। আর সংগঠনের মেন্টর পদে বসিয়ে সামগ্রিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নন্দীগ্রামের বিধায়ক তথা রাজ্যের পরিবহণ, সেচ ও জলসম্পদ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীকে। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সেই কাঠামো ভেঙে দিল তৃণমূল। ফেডারেশনের সর্বোচ্চ স্তরে ঢালাও রদবদল করে দেওয়া হল। এবং সেই রদবদলেই শুভেন্দু অধিকারীর নীরব প্রস্থান ঘটে গেল ফেডারেশনের মাথা থেকে।
সোমবার রাতের এক বৈঠকে এই রদবদল ঘটেছে। দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী এবং মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় সে দিন তৃণমূল ভবনে বৈঠকে বসেন কর্মচারী ফেডারেশনের নেতাদের নিয়ে। সে বৈঠকে দলের চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফোনে ভাষণ দেন। সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে তৃণমূলের সংগঠনকে আরও মজবুত করার বার্তা দেন মমতা। এবং সেই লক্ষ্যে সংগঠনের খোলনলচে বদলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ওই বৈঠকেই। ফেডারেশনের যাবতীয় কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে ওই বৈঠকে। আহ্বায়ক পদে যে ৩ জন ছিলেন, তাঁদের মধ্যে দু’জনকেই অব্যাহতি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সংগঠনের ভার ন্যস্ত হয়েছে দিব্যেন্দু রায়ের উপরে। তাঁর নেতৃত্বেই রাজ্য এবং জেলা স্তরের পূর্ণাঙ্গ কমিটি শীঘ্রই নতুন করে গঠিত হবে বলে স্থির হয়েছে।
আরও পড়ুন: দিলীপকে বার্তা নড্ডার, সঙ্ঘাত স্থগিত, ড্যামেজ কন্ট্রোল শুরু বিজেপিতে
রাজ্যের শাসকদল হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে তৃণমূলের সংগঠন এখনও একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বরং সরকারি কর্মীরা বড় ধাক্কা দিয়ে দিয়েছিলেন তৃণমূলকে। পোস্টাল ব্যালটের গণনায় তৃণমূলের চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিল বিজেপি। মহার্ঘ ভাতা, বেতন কমিশন-সহ নানা দাবিদাওয়া নিয়ে কর্মীদের সঙ্গে সরকারের যে দীর্ঘ টানাপড়েন, তার জেরেই পোস্টাল ব্যালটে ওই বিপর্যয়ের মুখ দেখতে হয়েছিল বলে তৃণমূল নেতাদের একাংশ মনে করেছিলেন। সেই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতেই সরকারি কর্মীদের মধ্যে ফেডারেশনের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা নতুন করে তৃণমূল শুরু করে। শুভেন্দু অধিকারীর মতো হেভিওয়েটকে দলের তরফ থেকে ফেডারেশন দেখভালের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু তৃণমূলের একাংশের দাবি, গত এক বছরে ফেডারেশনের শক্তি মোটেই বাড়েনি। শুভেন্দু সে ভাবে সময়ই দেননি ফেডারেশনকে। সংগঠনের নানা স্তরের কমিটিগুলোও তৈরি করা হয়নি। এই পরিস্থিতিতেই ফের ফেডারেশনের নেতৃত্বকে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিতে হল বলে তৃণমূল নেতাদের অনেকের মত।
সোমবারের যে বৈঠকে ফেডারেশনে রদবদল ঘটল, সেই বৈঠকে কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী উপস্থিত ছিলেন না। এত দিন দলের তরফে ফেডারেশন দেখভালের দায়িত্ব ছিল যাঁর উপরে, সেই শুভেন্দুই কেন নেই বৈঠকে? এ প্রশ্নের সদুত্তর ফেডারেশনের কেউ দিতে পারেননি। রদবদলের মাধ্যমে যে রকম নীরবে শুভেন্দুর হাত থেকে সরিয়ে নেওয়া হল ফেডারেশনের দায়িত্ব, সে বিষয়েও কেউ মন্তব্য করতে চাননি।
তা হলে কি তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে যে জল্পনা দিন দিন বাড়ছে, তা ভিত্তিহীন নয়? শুভেন্দু যে ভাবে দল ও সরকারের একের পর এক কর্মসূচি এড়াচ্ছেন, তার জেরেই কি এ বার পূর্ব মেদিনীপুরের দাপুটে নেতার উপরে আর ভরসা করতে চাইছে না রাজ্যের শাসকদল? শুভেন্দু অধিকারী দল ছেড়ে দিতে পারেন বলে যে গুঞ্জন গত কয়েক মাস ধরেই রাজ্যের রাজনৈতিক শিবিরে চলছে, তাকে তৃণমূল নেতারা এত দিন নস্যাৎই করছিলেন। কিন্তু এ বার যে ভাবে ফেডারেশনের মাথা থেকে শুভেন্দুকে সরিয়ে দেওয়া হল, তাতে স্পষ্ট যে, শুভেন্দুকে নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্বের ভাবনাও এ বার বাঁক নিতে শুরু করেছে। মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।
ফেডারেশনের দায়িত্ব যিনি পেলেন, সেই দিব্যেন্দু রায় মুখে কুলুপ এঁটেছেন শুভেন্দুর বিষয়ে। নতুন দায়িত্ব পেয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত। সংগঠনে কাউকে ব্রাত্য হতে দেবেন না, সকলকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করবেন— এ কথা বার বার বলছেন দিব্যেন্দু। সৌম্য ঘোষ এবং তপন গড়াইকে আহ্বায়ক পদ থেকে সরিয়ে যে ভাবে শুধু দিব্যেন্দুকে রাখা হয়েছে, তার জেরে কোনও অংশের মধ্যে ক্ষোভ যাতে না বাড়ে, সেটুকু নিশ্চিত করতেই ‘সবাইকে নিয়ে চলা’র কথা বার বার আওড়াচ্ছেন দিব্যেন্দু। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর অপসারণের প্রসঙ্গ এলেই তিনি মন্তব্য এড়াচ্ছেন।
আরও পড়ুন: ফুসফুসে সংক্রমণের লক্ষণ, প্রণবের শারীরিক অবস্থার অবনতি
‘‘শুভেন্দু অধিকারী অনেক সিনিয়র নেতা। তাঁর বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। ওটা দলের সিদ্ধান্ত। দল যা ভাল বুঝেছে করেছে। ওটা নিয়ে আমার কোনও কথাই বলার নেই।’’ বুধবার আনন্দবাজার ডিজিটালকে এ কথাই বলেছেন দিব্যেন্দু রায়। কিন্তু শুভেন্দুর অপসারণে কি ফেডারেশন আদৌ শক্তিশালী হবে? নাকি সংগঠনে ক্ষোভ বাড়ার ইঙ্গিত মিলছে? এই প্রশ্নে মুখ খুলছেন দিব্যেন্দু। বলছেন, ‘‘ক্ষোভ-বিক্ষোভের কোনও জায়গাই নেই। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি যা নির্দেশ দেবেন, সকলে সেটা অক্ষরে অক্ষরে মনে চলবেন।’’ অর্থাৎ শুভেন্দু অধিকারী এত দিন দায়িত্বে ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর অপসারণে সংগঠনের কিছু যায়-আসে না— এই বার্তাই ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন ফেডারেশনের নতুন নেতৃত্ব।
দিব্যেন্দু রায় যা-ই বলুন, ক্ষোভের আঁচ কিন্তু মিলতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। প্রকাশ্যে মুখ খোলা থেকে অনেকেই বিরত থাকছেন। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর অপসারণ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের অন্যতম তথা সংগঠনের প্রবীণ নেতা মনোজ চক্রবর্তী ক্ষোভ গোপনও করেননি। তাঁর কথায়, ‘‘এত বড় সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হল, তখন অবশ্যই শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে কথা বলে সেটা করা উচিত ছিল। দল কি আদৌ কথা বলেছে? আমার মনে হয় না।’’
শুভেন্দু অধিকারী নিজে এখনও কোথাও মুখ খোলেননি ফেডারেশনের এই রদবদল নিয়ে। তবে ফেডারেশনের মাথা থেকে তাঁর অপসারণই যে প্রথম ধাক্কা, তা কিন্তু নয়। সম্প্রতি দল ও যুব সংগঠনের ঢালাও রদবদলেও শুভেন্দু শিবিরে কোপ পড়তে দেখা গিয়েছে। পরিবহণ মন্ত্রীর নিজের জেলা পূর্ব মেদিনীপুরে যুব তৃণমূলের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে শুভেন্দু অনুগামী হিসেবে পরিচিত সংগ্রাম দলুইকে। নতুন সভাপতি পদে যাঁকে বসানো হয়েছে, তিনি শুভেন্দুর বিপরীত শিবিরের নেতা হিসেবেই পরিচিত। শুভেন্দু তা নিয়েও নিজে কিছু বলেননি। কিন্তু ময়নার বিধায়ক সংগ্রাম মুখ বন্ধ রাখেননি। তাঁর অপসারণ আসলে শুভেন্দুকেই আঘাত করার জন্য, এমন ইঙ্গিত প্রকাশ্যেই দিতে শুরু করেছিলেন তার। সে সবের পরেও যে ভাবে ফেডারেশনের দায়িত্ব থেকে শুভেন্দুকে অব্যহতি দিয়ে দেওয়া হল, তাতে তৃণমূল নেতৃত্বের বার্তা পড়তে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের মত।
এই প্রসঙ্গে শুভেন্দুর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হয়। মেসেজ করা হয় তাঁকে। এখনও পর্যন্ত তার জবাব মেলেনি।