‘ক্যারি অন’ বললেন চেল্লুর, উঠে গেল বয়কট

বাইরে চলছে আদালত বয়কটকারী আইনজীবীদের চিৎকার। তুমুল হট্টগোলের মধ্যে হাইকোর্টের এজলাসে কাজ করতে পারছিল না ডিভিশন বেঞ্চ। আচমকা সেখানে হনহনিয়ে ঢুকে পড়লেন সাদা-কালো সিল্কের শাড়ি আর কালো কোট পরা এক মহিলা। এক জন বিচারপতির দিকে তাকিয়ে সটান বললেন, ‘‘ক্যারি অন ব্রাদার!’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৪৭
Share:

বাইরে চলছে আদালত বয়কটকারী আইনজীবীদের চিৎকার। তুমুল হট্টগোলের মধ্যে হাইকোর্টের এজলাসে কাজ করতে পারছিল না ডিভিশন বেঞ্চ। আচমকা সেখানে হনহনিয়ে ঢুকে পড়লেন সাদা-কালো সিল্কের শাড়ি আর কালো কোট পরা এক মহিলা। এক জন বিচারপতির দিকে তাকিয়ে সটান বললেন, ‘‘ক্যারি অন ব্রাদার!’’

Advertisement

হতচকিত এজলাস! যাঁকে উদ্দেশ করে বলা হল ওই কথা, হতভম্ব সেই বিচারপতি গিরীশ গুপ্তও। হতভম্ব তাঁর সহকর্মী বিচারপতি শিবসাধন সাধুও। তাঁদের সামনে তখন দাঁড়িয়ে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুর। ওই একটি বাক্য বলেই যিনি গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলেন এজলাসের পিছনের দরজা দিয়ে।

এক প্রবীণ আইনজীবীর সঙ্গে বিচারপতি গুপ্ত সঠিক আচরণ করেননি— এই অভিযোগে গত ২২ জুলাই থেকে বিচারপতি গুপ্তের ডিভিশন বেঞ্চ বয়কট করে আসছিলেন আইনজীবীদের একাংশ। টানা দু’সপ্তাহ ধরে এই বয়কট চলায় বিচারপ্রার্থীরা বিপাকে পড়েছেন। বিচারপতি গুপ্ত বারবার বলেছেন, আইনজীবীরা তাঁর আদালত বয়কট করতেই পারেন, কিন্তু তাঁরা আদালতের কাজে বাধা দিতে পারেন না। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বয়কটকারীরা নিজেরা শুধু বিচারপতি গুপ্তের আদালত বয়কট করেই ক্ষান্ত হননি, অন্যদেরও ওই এজলাসে যেতে বাধা দিয়ে চলেছেন। আর এই সমস্ত বাধা তোয়াক্কা না করেই আদালত চালিয়ে যাচ্ছিলেন বিচারপতি। কিন্তু বুধবার স্বয়ং প্রধান বিচারপতি তাঁর এজলাসে এসে বিক্ষোভকারীদের কড়া বার্তা দিয়ে গেলেন এবং কার্যত বিক্ষোভ উঠে গেল।

Advertisement

ঘটনার সূত্রপাত বেলা সওয়া ১১টায়। বিচারপতির নির্দেশ মতো এ দিন হাইকোর্টের আইনজীবী সংগঠনের কর্মকর্তারা তাঁর আদালতে হাজির হয়েছিলেন বয়কট নিয়ে তাঁদের বক্তব্য জানাতে। হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ দাস আদালতে জানান, যে আইনজীবীরা আদালতের কাজে বাধা দিচ্ছেন, তাঁদের তিনি চেনেন না। সেই কারণে তাঁদের তালিকা বিচারপতি গুপ্তকে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। এই কথা শুনে বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘‘বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতিই তাঁর সংগঠনের সদস্যদের চেনেন না!’’ এর পরে বিচারপতি তাঁকে বলেন, ‘‘বয়কট নিয়ে আপনারা আপনাদের বক্তব্য জানান।’’ এই কথা শুনে সভাপতি বলেন, ‘‘এ ব্যাপারে আমাদের আগামী সোমবার পর্যন্ত সময় দেওয়া হোক।’’ বিচারপতি তা মঞ্জুর করেন।

আইনজীবী সংগঠনের কর্তারা এর পর আদালত থেকে বেরিয়ে যান। এই সময় প্রমিত রায় নামে আইনজীবীদের একটি সংগঠনের কর্তা বিচারপতি গুপ্তের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আইনি পরিসীমার মধ্যেই আদালত বয়কট নিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধান যাতে খুঁজে বার করা যায়, তার ব্যবস্থা করা হোক।’’ উত্তরে বিচারপতি গুপ্ত বলেন, ‘‘আমার কোনও বক্তব্য নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। আমার বিরুদ্ধে কোনও আইনজীবীর অভিযোগ, ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু এক জন বিচারপতি শৃঙ্খলাভঙ্গ করছেন কি না, তা এক জন আইনজীবী কী করে বিচার করতে পারেন?’’ বিচারপতি প্রশ্ন করেন, এক জন আইনজীবী কী করে বিচার ব্যবস্থায় বাধা দিতে পারেন? তাঁর কথায়, ‘‘হাইকোর্ট এমনকী সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকেও তাঁর পদ থেকে সরানো সম্ভব। কিন্তু তার একটি পদ্ধতি রয়েছে। আমি অন্য কোনও আদালতে বদলি নিতে পারি, পদত্যাগও করতে পারি। আমি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত এক জন সাধারণ মানুষ। আমি ‘লর্ড’ নই। কিন্তু আইনজীবীদের কি বিচার ব্যবস্থায় এই ভাবে হস্তক্ষেপ করার অধিকার রয়েছে?’’

এর পরে প্রমিতবাবু আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। বিচারপতি গুপ্ত তাঁর অফিসারদের নির্দেশ দেন, তালিকা ধরে মামলাকারীদের ডাকতে। তাঁদের কয়েক জন হাজির হন। কিন্তু বাইরে বয়কটকারীদের তুমুল চিৎকারে আদালতের কাজে অসুবিধা হতে থাকে। সূত্রের খবর, এই গোলমালের খবর কয়েক জন আইনজীবীর মাধ্যমে কানে যায় প্রধান বিচারপতির। অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র এবং শেখর বসু-মিলন মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীণ আইনজীবীদের তাঁর এজলাসে ডেকে প্রধান বিচারপতি চেল্লুর জানান, তিনি নিজে এবং তাঁর ডিভিশন বেঞ্চের অন্য বিচারপতি জয়মাল্য বাগচী একসঙ্গে বিচারপতি গুপ্তের আদালতে যেতে চান। আইনজীবীরা যেন তাঁদের সঙ্গে ওই আদালতে ঢোকেন। এর পরেই হাইকোর্টের দোতলায় নিজের এজলাস (এক নম্বর আদালত) থেকে নেমে বিচারপতি গুপ্তের এজলাসে (চার নম্বর আদালত) প্রায় ৩০-৪০ জনের একটি দল নিয়ে ঢুকে পড়েন তিনি। বিচারপতি গিরীশ গুপ্তকে ‘ক্যারি অন, ব্রাদার’ বলে উৎসাহ জুগিয়ে ফিরে আসেন নিজের এজলাসে। প্রধান বিচারপতির তরফে এমন পদক্ষেপে রীতিমতো হতচকিত হয়ে যান বয়কটকারীরা। হাইকোর্টের এক প্রবীণ আইনজীবীর কথায়, ‘‘প্রধান বিচারপতি অন্যের এজলাসে চলে আসছেন এ রকম ঘটনা কখনও দেখিনি! তিনি নিজে এসে বয়কটকারীদের উদ্দেশে বার্তা দিয়ে গেলেন।’’ এর পরে আর আদালতের কাজে বাধা দেওয়ার সাহস করেননি বিক্ষোভকারীরা। আইনজীবীদের একাংশের বক্তব্য, এর আগে হাইকোর্টের কর্মসংস্কৃতি নিয়ে একাধিক বার প্রশ্ন তুলেছেন প্রধান বিচারপতি। কেউ মারা গেলেই তাঁর স্মরণে আদালত ছুটি দিয়ে দেওয়া, ছুতোয়নাতায় কর্মবিরতির ডাক দেওয়ার বিরুদ্ধে বারবার সরব হয়েছেন তিনি। আইনজীবীদের বলেছেন, ‘‘বিচারপ্রার্থীরাই তো আপনাদের লক্ষ্মী!’’ বিচারপতি গিরীশ গুপ্ত যে ভাবে কিছু দিন সব রকম অসহযোগিতা উপেক্ষা করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তা অজানা ছিল না প্রধান বিচারপতির। এ দিন তিনি নিজেই বিচারপতি গুপ্তের এজলাসে গিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, আদালতের কাজে বাধা দিলে কড়া হতে তিনি পিছপা হবেন না।

প্রধান বিচারপতি চলে যাওয়ার পরেই রাজ্যের অ্যাডভোকেট জেনারেল জয়ন্ত মিত্র বিচারপতি গুপ্তের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আশা করি, আপনাকে আলাদা করে বলতে হবে না বয়কটকারী-সহ প্রবীণ আইনজীবীদের নিয়ে প্রধান বিচারপতির এই আদালতে আসার অর্থ কী! এর অর্থ বয়কট উঠে গিয়েছে।’’ বিচারপতি গুপ্ত তা শুনে জয়ন্তবাবুকে বলেন, ‘‘খুব ভাল।’’ এর পরেই তিনি কোর্ট অফিসারদের নির্দেশ দেন, তালিকা ধরে মামলার আবেদনকারীদের নাম ডাকতে। এর পরে মামলা চালাতে আর কোনও অসুবিধার মুখে পড়তে হয়নি বিচারপতিকে।

তবে হাইকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্মকর্তা পরে বলেন, ‘‘বিচারপতি গুপ্তের আদালতে কাজ না-করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সাধারণ সভার বৈঠক ডেকে। সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে গেলেও সাধারণ সভার বৈঠক ডাকতে হবে। তার পরেই আনুষ্ঠানিক ভাবে বলা যাবে, বিচারপতি গুপ্তের আদালতে ফের কাজে যোগ দেওয়া হবে কি না।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement