Partha Chatterjee

বেহালায় শিশুমৃত্যুর জের, ভাঙা পড়তে পারে ফুটপাথ লাগোয়া বিধায়ক পার্থের ‘বেআইনি’ ঘর

পুলিশ ও পুরসভা একযোগে বেহালার ডায়মন্ড হারবার রোডের ফুটপাত লাগোয়া অংশে বেআইনি ভাবে তৈরি হওয়া যাবতীয় নির্মাণ ভাঙতে উদ্যোগী হচ্ছে। ম্যান্টনের কাছের ফুটপাথের ঘরটি নজরে এসেছে প্রশাসনের।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২৩ ১৩:১০
Share:

পার্থ চট্টোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।

গত শুক্রবার বেহালা চৌরাস্তা এলাকায় পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে সাত বছরের শিশু সৌরনীল সরকার। তার মৃত্যুতে বেহালার জনতার ক্ষোভের আঁচ পৌঁছেছে চরমে। সেই ক্ষোভ প্রশমিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে প্রশাসন। ফুটপাথের দু’পাশ থেকে বেআইনি নির্মাণ এবং দোকান ইত্যাদি ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে জনসাধারণের চলাচলের পরিসর প্রশস্ত করার জন্য। সেই মর্মে প্রশাসনিক পদক্ষেপও করা হচ্ছে।

Advertisement

সূত্রের খবর, প্রশাসনিক পদক্ষেপের এই পর্যায়ে ভাঙা পড়তে পারে ‘বেআইনি ভাবে’ তৈরি ফুটপাথ লাগোয়া পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ‘এসি রুম’। গত কয়েক দিনের ঘটনাক্রম তেমনই বলছে। কলকাতা পুলিশ এবং কলকাতা পুরসভা একযোগে বেহালার ডায়মন্ড হারবার রোডের ফুটপাথ লাগোয়া অংশে বেআইনি ভাবে তৈরি যাবতীয় নির্মাণ ভাঙতে উদ্যোগী হচ্ছে। সেই সূত্রেই বেহালা ম্যান্টনের কাছের ফুটপাথে বিধায়ক তথা প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থের বসার যে বাতানুকূল ঘরটি রয়েছে, সেটি নজরে এসেছে প্রশাসনের। তার পরেই সেটি ভাঙার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে প্রশাসন।

২০০১ সালে বেহালা পশ্চিম থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন পার্থ। দু’বারের সিপিএম বিধায়ক তথা বেহালার সরশুনা এলাকার বাসিন্দা সিপিএম নেতা নির্মল মুখোপাধ্যায়কে হারিয়ে বেহালায় নিজের রাজনৈতিক ইনিংস শুরু করেছিলেন তিনি। বিধায়ক হওয়ার পরেই বেহালার ম্যান্টনে নিজের জনসংযোগ কার্যালয় তৈরি করেন পার্থ। জেলযাত্রার আগে পর্যন্ত সেখান থেকেই নিজের বিধানসভা এলাকার কাজকর্ম দেখতেন তিনি। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে জেতার পর ম্যান্টনের সেই অফিসের বাইরে ফুটপাথ লাগোয়া একটি জায়গা তৈরি হয় পার্থের বসার জন্য। সেটি তৈরি হওয়ার পর থেকে বেশিরভাগ সময় নিজের বিধানসভা এলাকায় এলে সেখানেই বসতেন তিনি। পুরসভা সূত্রের খবর, জায়গাটি একপ্রকার ‘জবরদখল’ করেই নেওয়া হয়েছিল। পার্থ রাজ্যের দাপুটে মন্ত্রী এবং শাসকদলের প্রথম সারির নেতা হওয়ায় কেউ এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি।

Advertisement

২০২১ সালে পঞ্চম বার পার্থ বেহালা পশ্চিমের বিধায়ক হওয়ার পরে ওই ফুটপাথ লাগোয়া জায়গাটি সাজিয়ে তোলার কাজ শুরু হয়। মহার্ঘ কাচ দিয়ে ঘিরে, পর্দা লাগিয়ে ঘরটিকে করে তোলা হয় বাতানূকুল। মেঝেতে বসানো হয় দামি টাইল্‌স। তাঁর বসার জায়গাটি তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে বিশেষ প্রয়োজন বা জরুরি বৈঠক ছাড়া আর জনসংযোগ কার্যালয়ে ঢুকতেন না পার্থ। ২০২২ সালের জুলাইয়ে শেষ বার নিজের বিধানসভা কেন্দ্রে এসে ওই বাতানুকূল ঘরটিতেই বসেছিলেন তিনি। ২০২২ সালের ২৩ জুলাই পার্থ গ্রেফতার হওয়ার পর বিধায়ক কার্যালয় খোলা হলেও ওই ঘরটি আর খোলা হয়নি। তবে সেটি পরিচ্ছন্ন রাখা হত।

গত শুক্রবার পথ দুর্ঘটনায় স্কুলপড়ুয়া শিশুর মৃত্যুর ঘটনায় ডায়মন্ড হারবার রোডের ফুটপাথ লাগোয়া এলাকা খালি করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরেই প্রশাসনের নজরে পড়ে পার্থের জন্য তৈরি ঘরটি। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, শেষমুহূর্তে পরিকল্পনায় কোনও বদল না-হলে ওই ঘরটি ভেঙে ফেলা হবে। স্থানীয় ১৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তথা কলকাতা পুরসভার মেয়র পরিষদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় সোমবার বলেন, ‘‘পুলিশ এবং পুরসভা একযোগে ওই অফিসের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। কারও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে কিছু হবে না।’’ প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ‘বেআইনি’ ঘর ভাঙা নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত মতামত জানতে চাওয়া হলে কাউন্সিলর বলেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে আমার কোনও ব্যক্তিগত মতামত নেই। প্রশাসন যা সিদ্ধান্ত নেবে, তা-ই আমার সিদ্ধান্ত।’’

প্রশাসনের এমন সিদ্ধান্তকে অবশ্য ‘বিলম্বিত বোধোদয়’ বলছেন বেহালার বিজেপি নেতৃত্ব। বিজেপি নেত্রী রাখী চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘শাসকদলের এত বড় একজন নেতা হয়ে দিনের পর দিন বেআইনি কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বেহালার আইন সচেতন মানুষ সকলেই জানতেন, তাঁর ওই বসার জায়গাটি বেআইনি ভাবে তৈরি। এ ছাড়াও বেহালা ম্যান্টনের ওই ফুটপাথ এবং ডায়মন্ড হারবার রোডের বড় একটা অংশ পার্থবাবু ও তাঁর অনুগামীদের জন্য গার্ড রেল দিয়ে ঘিরে রাখতে পুলিশ। ক্ষমতায় আছেন বলে কেউ মুখ খুলত না। এ সব কাজ দিনের পর দিন হয়েছে বেহালার মানুষের চোখের সামনে। আমরা সবাই তখন চোখ বুজে ছিলাম। গরিব মা-বাবার সন্তানকে প্রাণ দিয়ে আমাদের চোখ খোলাতে হয়েছে। এটা আমাদের মতো বেহালাবাসীদের কাছে লজ্জার। এমন আরও অনেক কাজ পার্থবাবু বেহালায় করে গিয়েছেন, যা দিনে দিনে প্রকাশ পাবে।’’

পার্থের ‘বেআইনি’ অফিসটি নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ বেহালা তৃণমূলের কোনও নেতাই। তবে ঘরোয়া আলোচনায় তাঁরা বলছেন, ‘‘পার্থদা এখন সাসপেন্ডেড। তাই তাঁর করে-যাওয়া ভুল কাজের জবাব দেওয়ার দায় আমাদের নয়।’’ বস্তুত, দলের অনেকের মতে, পার্থকে নিয়ে দলের শীর্ষনেতৃত্বও ‘বিড়ম্বিত’। তাঁর কৃতকর্মের ‘দায়’ তাঁরাও নিতে নারাজ। তাই পথ দুর্ঘটনায় শিশুমৃত্যুর পর যে সমস্ত ‘প্রশাসনিক পদক্ষেপ’ করা হচ্ছে, সেগুলি সামনে রেখেই পার্থের জন্য নির্মিত বাতানুকূল ঘরটিও ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। কারণ, এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, জামিন পেলেও ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে পার্থ আর তৃণমূলের টিকিট পাবেন না। ফলে তাঁর বিশেষ ঘরের আর প্রয়োজনও হবে না। পক্ষান্তরে, পার্থের নির্মিত ঘরটি ভেঙে দিলে জনমানসে একইসঙ্গে দু’টি বার্তা দেওয়া যাবে। এক, কেন্দ্র নিজেদের দখলে থাকলেও জন পরিষেবার প্রশ্নে শাসকদল আপস করবে না। দুই, পার্থ আর দলের দূরত্ব এখন এতটাই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement