দলের সাংগঠনিক সংস্কারের লক্ষ্যে প্লেনাম হচ্ছে। তার আগে রাজ্য কমিটির বৈঠকে রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলছেন, ঘরে থেকে যাঁরা শক্রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন, তাঁরা চলে যান। তাতে দল ছোট হলে হোক! সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক যখন এমন বলছেন, তখন দলের শ্রমিক সংগঠনে দিব্যি চলছে ‘দ্বৈত সদস্যপদে’র সংস্কৃতি! অর্থাৎ তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনে নাম লিখিয়েও গোপনে সিটু করছেন অনেকে!
গণসংগঠনকে স্বাধীন ভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেওয়ার কথা ফের উঠে আসতে শুরু করেছে সিপিএমের আসন্ন প্লেনামকে কেন্দ্র করে। গণসংগঠনের ক্ষেত্রে বলা হয়, সেখানে যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের সংশ্লিষ্ট দলের সদস্য হতেই হবে, এমন কোনও কথা নেই। কিন্তু এই ‘স্বাধীন চরিত্রে’র বর্মের আড়ালে সম্পূর্ণ প্রতিপক্ষ দুই শিবিরে একই সঙ্গে পা দিয়ে চলা আদৌ গ্রহণযোগ্য কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে সিপিএমের অন্দরেই।
সিটুর নেতৃত্ব অবশ্য বলছেন, পরিস্থিতির চাপে জেনেশুনেই তাঁরা এই দ্বৈত সদস্যপদ মেনে নিতে এক প্রকার ‘বাধ্য’ হচ্ছেন! অসংগঠিত ক্ষেত্রে এখন শ্রমিকের সংখ্যা বিপুল। দ্বৈত সদস্যদের অস্বীকার করলে খাতায়-কলমে অসংগঠিত ক্ষেত্রে আরও তলানিতে চলে যাবে সিটু। বাম জমানা শেষ হওয়ার পরে এমনিতেই সব ক্ষেত্রে সিটুর সদস্য ৪০% কমেছে। পরিবহণ, নির্মাণ শিল্পের শ্রমিক, হকার ও ক্ষেত মজুরদের থেকেই সিটুর সঙ্গত্যাগ এবং তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়নে নাম লেখানোর ঘটনা ঘটছে মেনে নিয়ে সিটুর রাজ্য সভাপতি শ্যামল চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘রুটি-রুজির টানে, ভয়ে তাঁরা এই কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা মানসিক ভাবে সিটুতেই রয়েছেন।’’
যদিও আইএনটিটিইউসি-র প্রবীণ নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের পাল্টা বক্তব্য, ‘‘যে সংগঠনের নেতারা হতাশ, তাঁদের দলে শ্রমিকেরা থাকবেন কেন! রুটি-রুজি তো মূল কথা। কিন্তু এই অবস্থার জন্য চেক-আপের ঘাটতিই দায়ি। চেক-আপ পদ্ধতি না থাকলে দ্বৈত সদস্যপদ থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। ভয় দেখানোর অজুহাতটা ঠিক নয়!’’
তথ্য বলছে, এই প্রবণতার শুরু ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে। তৃণমূল ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে তা বাড়তে থাকে। এমন দ্বৈত সদস্যপদের সংস্কৃতি অতীতে কোনও কালে হয়েছে বলে মনে করতে পারছেন না ট্রেড ইউনিয়নের প্রবীণ নেতারা। সিপিএমের নেতারাও এখন বুঝতে পারছেন, আগে খাতায়-কলমে থেকে যাওয়া সদস্যদের ভিড় ছিল অনেকটাই ফাঁপা। অর্থাৎ ক্ষমতার সঙ্গে লেগে থাকাটাই ছিল উদ্দেশ্য। সেখানে ভালবাসা বা নীতির কোনও জায়গা ছিল না। তা হলে সূর্যবাবু যে ভাবে বলছেন, সেই অনুযায়ী এঁদেরও কি ‘ঘরের শত্রু’ ধরা উচিত? সিটুর নেতারা তা মানতে নারাজ। তাঁদের ব্যাখ্যা, মিটিং-মিছিলে না থাকলেও কেন্দ্রীয় কোনও কর্মসূচিতে এই ধরনের সদস্যেরা পাশে থাকেন। গোপনে চাঁদাও দেন। তাই ওঁরা অন্তত বিশ্বাসঘাতকের কাজ করছেন না!
সিটুর এক নেতার দাবি, আগামী ২ সেপ্টেম্বরের ধর্মঘটে বেলা ১০টার পরে অটো-চালকেরা সামিল হবেন। ফলে, বেলা বাড়লে রাস্তায় অটোর দেখা মিলবে না। দ্বৈত ভূমিকায় থেকেও শ্রমিকদের একাংশ যে পাশে আছেন, সে দিন তার উদাহরণ মিলবে!
ক্ষমতা পরিবর্তনের পরে ঝাঁকে ঝাঁকে দল ছাড়ার ঘটনায় সংগঠন নিয়ে সিপিএম উদ্বিগ্ন। সিটুর নেতাদের মতে, এই অবস্থায় তৃণমূলের ট্রেড ইউনিয়নে নাম লেখানো সদস্যদের সিটু থেকে একেবারে তাড়ানো হলে পরিবহণ, রিক্সা, ভ্যান চালক এবং হকারদের মতো নিচু তলার সংগঠনে তাঁদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। সিটুর কলকাতা জেলা সম্পাদক দেবাঞ্জন চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘আমরা তাঁদের রোজগার দিতে পারব না। নিরাপত্তাও না। অনেকেই আছেন, যাঁরা তৃণমূলের সংগঠনে থেকেও গোপনে আমাদের চাঁদা দিচ্ছেন। বাড়ি থেকে তাঁদের চাঁদা নিয়ে আসা হয়। পরিস্থিতির চাপে এই দ্বৈত সদস্যপদকে মেনে নিতে হচ্ছে।’’