রাজ্য কমিটির বৈঠকে সূর্যকান্ত মিশ্র। সোমবার। —নিজস্ব চিত্র।
সব জল্পনার অবসান। প্রথা ভেঙেই এ বার বিধানসভা ভোটে প্রার্থী হচ্ছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। নিজের বিধানসভা কেন্দ্র নারায়ণগড় থেকেই।
স্মরণকালের মধ্যে সিপিএমের কোনও রাজ্য সম্পাদকই ভোটে প্রার্থী হননি। প্রমোদ দাশগুপ্ত, সরোজ মুখোপাধ্যায়, শৈলেন দাশগুপ্ত, অনিল বিশ্বাস বা বিমান বসু— সকলেই সাংগঠনিক কাজে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতেন। কিন্তু এ বার তার অন্যথা হচ্ছে। সিপিএমের যুক্তি, বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। এ ছা়ড়াও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর আরও চার সদস্য অশোক ভট্টাচার্য, অমিয় পাত্র, রবীন দেব এবং রামচন্দ্র ডোম এ বার প্রার্থী। দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এখন রাজ্যসভার সাংসদ। সেই অর্থে দেখতে গেলে নয়া জমানায় সিপিএমের সাংগঠনিক নেতারা সংসদীয় রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেলেন।
সূর্যবাবুকে প্রার্থী চেয়ে আলিমুদ্দিনে চিঠি পাঠিয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএম। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা নেতৃত্ব যাদবপুর থেকে সূর্যবাবুকে প্রার্থী করতে উৎসাহী ছিলেন। আবার পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিএম নারায়ণগড়ে প্রথম পছন্দ হিসাবে বর্তমান বিধায়কের নামই রেখেছিল। গোড়ায় আপত্তি থাকলেও রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর বড় অংশ শেষ পর্যন্ত সূর্যবাবুকে প্রার্থী করার পক্ষে সওয়াল করে। তবে দলীয় সূত্রের খবর, সূর্যবাবু সোমবারও রাজ্য নেতৃত্বকে প্রথমে বলেন, ভোট দাঁড়াতে তিনি রাজি নন। এমনিতেই রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর থেকে বিরোধী দলনেতার দায়িত্ব সামলাতে তাঁর সমস্যা হচ্ছে। তার উপরে ভোটে আবার প্রার্থী হলে দলের কাজে মন দেওয়া কঠিন হবে। কিন্তু রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী এই আপত্তি মানেনি।
এ দিন সন্ধ্যায় আলিমুদ্দিনে প্রথম দফার প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করতে গিয়ে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ‘‘সূর্য মিশ্র প্রার্থী হতে চাননি। সবাই চাওয়ায় প্রার্থী হলেন।’’ সিপিএম সূত্রের খবর, ভোটে দাঁড়ানোর জন্য প্রবল চাপ আসার পরে সূর্যবাবু বলেন, একান্তই প্রার্থী হতে হলে তিনি কেন্দ্র বদল করতে নারাজ। গত লোকসভা এবং পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখে নারায়ণগড় সিপিএমের জন্য মোটেই নিরাপদ নয়। কিন্তু সূর্যবাবুর যুক্তি, অন্য কেন্দ্রে প্রার্থী হলে তিনি হারের ভয়ে সরে এলেন, এই প্রচারের সুযোগ তৃণমূল পেয়ে যাবে। জেলা সিপিএমের নেতৃত্ব অবশ্য আলিমুদ্দিনকে জানিয়ে দিয়েছেন, এখন হয়তো তাঁদের কথা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। কিন্তু তাঁরা নারায়ণগড় আসন জিতিয়ে দেখাবেন!
কোন অঙ্কে? মূলত দু’টি কারণ বলছে জেলা সিপিএম। প্রথমত, সূর্যবাবু গত পাঁচ বছরে সিপিএমের ‘মুখ’ হিসেবেই উঠে এসেছেন। তাঁর নেতৃত্বে জাঠা, পদযাত্রা কর্মসূচিতে ভাল সাড়াও মিলেছে। ফলে, লড়াকু হিসেবে তিনি ভোটারদের নজর কাড়বেন বলেই আশা। দ্বিতীয় কারণটির সঙ্গে জড়িয়ে আর এক সূর্য। গত বিধানসভা ভোটে সূর্যবাবুর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে হারেন তৃণমূল প্রার্থী সূর্য অট্ট। এ বার তাঁকে প্রার্থী করেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টিকিট পেয়েছেন তৃণমূলের জেলা কার্যকরী সভাপতি প্রদ্যোৎ ঘোষ। এই পরিস্থিতিতে শাসক দলের কোন্দল অনিবার্য বলে মনে করছে জেলা সিপিএম। তৃণমূলের সূর্যও বলছেন, ‘‘সূর্য মিশ্র দাঁড়ালে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি।’’ যদিও প্রদ্যোৎবাবুর দাবি, ‘‘লড়াই এতটুকু কঠিন
হবে না।’’
সূর্যবাবু ভোটে দাঁড়ালেও বামফ্রন্ট কাউকে মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী করে ভোটে যাচ্ছে না বলে এ দিন জানিয়ে দিয়েছেন বিমানবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘ভোটের পরে যাঁকে যোগ্য বলে মনে করা হবে, তাঁকেই নেতা নির্বাচন করা হবে।’’ যদিও দলীয় সূত্রের ব্যাখ্যা, ভোটে সামনে রাখার মতো মুখের অভাব যে সিপিএম-কে ভোগাচ্ছে, রাজ্য সম্পাদককে ভোটে দাঁড় করানোর নেপথ্যে সেটাও অন্যতম কারণ।
সূর্যবাবু নারায়ণগড়ে প্রার্থী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিঞ্চিৎ জটিলতা তৈরি হয়েছে যাদবপুর নিয়ে। ওই আসনে প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর। কিন্তু স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্বের বড় অংশ তাঁকে প্রার্থী হিসাবে মানতে নারাজ। তাঁরা সূর্যবাবুর জন্যই প্রায় জেদ ধরেছিলেন। এই অবস্থায় অন্য প্রার্থীর জন্য গোটা দল যাতে যাদবপুরে মাঠে নামে, তার জন্য এ দিন সন্ধ্যা থেকেই তৎপরতা শুরু হয়েছে সিপিএমে। যাদবপুরের প্রার্থীর নামও ঘোষণা করা হয়নি এ দিন।
তবে এ বারে প্রার্থী তালিকায় চমক সিঙ্গুর থেকে রবীনবাবুর প্রার্থী হওয়া। অতীতে তিনি বালিগঞ্জ থেকে বিধায়ক হয়েছিলেন। মমতার জমি আন্দোলনের অন্যতম আঁতুড়ঘর সিঙ্গুর এ বার ভোটে ফের আকর্ষণের কেন্দ্রে। এমনিতেই শিল্প না-হওয়ার ক্ষতি বুঝে হতাশার ছায়া নেমেছে সিঙ্গুরে। তার উপর মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি জানিয়ে দিয়েছেন, অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরতের বিষয়টি ৫০ বছর আদালতে আটকে থাকলেও তাঁর কিছু করার নেই। আবার বামেরা ঘোষণা করে দিয়েছে, রাজ্যে ফের ক্ষমতায় ফিরতে পারলে তারা সিঙ্গুরে কারখানাই করবে। এই অবস্থায় রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য রবীনবাবুকে প্রার্থী করে সিঙ্গুরের লড়াইতে নতুন মাত্রা যোগ করতে চাইল সিপিএম।
বাঁকুড়ার প্রাক্তন জেলা সম্পাদক এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয়বাবু প্রার্থী হচ্ছেন তালড্যাংরা থেকে। ওই কেন্দ্রের বিদায়ী বিধায়ক মনোরঞ্জন পাত্রকে আর প্রার্থী করা হচ্ছে না। শিলিগুড়ির মেয়র অশোকবাবু ফের প্রার্থী হচ্ছেন শিলিগুড়ি বিধানসভা কেন্দ্র থেকেই। সিউড়ি থেকে প্রার্থী রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর আর এক সদস্য রামচন্দ্রবাবু। রাজ্য কমিটির বৈঠকে জেলা নেতৃত্বকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, পারলে এ দিন রাত থেকেই প্রচারের কাজ শুরু করে দিতে হবে।