‘খোলা হাওয়া’র সূচনা করলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়।—নিজস্ব চিত্র।
সিদ্ধান্ত হয়েছিল রবিবারই। অনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হল আজ। কলকাতা প্রেস ক্লাবে বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলন করে টলিউডের শিল্পী ও কলাকুশলীদের নতুন সংগঠন ‘খোলা হাওয়া’র সূচনা করলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বাবুল সুপ্রিয়। টলিউডে ‘শ্বাসরোধ’ হয়ে যাচ্ছে শিল্পী ও কলাকুশলীদের, তাই নতুন সংগঠন তৈরি করতে হল। বললেন বাবুল। নাম না করলেও তিনি বেশ স্পষ্ট ভাবেই আঙুল তুললেন রাজ্যের মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং তাঁর ভাই স্বরূপ বিশ্বাসের দিকে। পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় স্বরূপের কটাক্ষ, ‘‘শ্বাসরোধ কারা করছেন, সে গোটা দেশ জানে।’’
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা সঙ্গীতশিল্পী বাবুল সুপ্রিয়কে মাথায় বসিয়ে টলিউডে নতুন সংগঠন যে গেরুয়া শিবির তৈরি করছে, সে কথা আগেই জানা গিয়েছিল। কারা এই সংগঠনে যোগ দিচ্ছেন, কারা নেতৃত্বে থাকছেন, সে সব সিদ্ধান্তও রবিবার গৃহীত হয়েছিল বিজেপি সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তর বাড়িতে হওয়া বৈঠকে। প্রত্যাশিত ভাবেই প্রধান উপদেষ্টা স্বপন দাশগুপ্ত, উপদেষ্টা রন্তিদেব সেনগুপ্ত, সভাপতি বাবুল সুপ্রিয়, সহ-সভাপতি অঞ্জনা বসু, আহ্বায়ক শঙ্কুদেব পন্ডাদের সামনে রেখেই এ দিন আত্মপ্রকাশ করল ‘খোলা হাওয়া’। রূপা ভট্টাচার্য, অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়, অরিন্দম চক্রবর্তী বা বলিউড থেকে আসা রিমি সেন-সহ অনেককেই দেখা গেল এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে। কিন্তু সংগঠনের অন্যতম সহ-সভাপতি হিসেবে যাঁর থাকার কথা, সেই অগ্নিমিত্রা পালকে বৃহস্পতিবার কলকাতা প্রেস ক্লাবের ত্রিসীমানাতেও দেখা গেল না। ফলে সামান্য হলেও হোঁচট রয়ে গেল সূচনা পর্বেই। অগ্নিমিত্রা এই সংগঠনে না-ও থাকতে পারেন, এমন জল্পনাও প্রথম দিনেই তৈরি হয়ে গেল।
বঙ্গ বিজেপির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়ের উদ্যোগেই টলিউডে এই নতুন সংগঠন তৈরির পথে হেঁটেছে গেরুয়া শিবির। এ রাজ্যের মন্ত্রী তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যতম আস্থাভাজন অরূপ বিশ্বাসের প্রভাব গত বেশ কিছু বছর ধরে এতই বেড়েছে বাংলা ফিল্ম ও টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে যে, শিল্পী ও কলাকুশলীদের নিয়ে তিন-চারটে সংগঠন তৈরি করেই টলিউডে দাঁত ফোটাতে পারেনি বিজেপি। সেই কারণেই বাবুল-স্বপনদের মতো ভারী নামকে আসরে নামিয়ে মোকাবিলার কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। কারও প্রভাব খর্ব করা যে এই নতুন সংগঠনের অন্যতম লক্ষ্য, সে কথা বেশ স্পষ্টও হয়ে গেল বাবুলের নানা মন্তব্যে।
আরও পড়ুন: মির্জার গ্রেফতারিতে রক্ষণাত্মক মুকুল, মন্তব্য এড়ালেন পার্থ, আরও আগে হল না কেন? প্রশ্ন দিলীপের
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর তথা ‘খোলা হাওয়া’র সভাপতির কথায়, ‘‘টলিউডে এখন আর কাজের কোনও স্বাধীনতা নেই। ‘স্বাধীন’ শব্দটাই হারিয়ে গিয়েছে টলিউড থেকে।’’ তিনি বলেন, ‘‘কয়েক জন লোকের অতিরিক্ত চাপে খোলা হাওয়ায় শ্বাস নেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছে।’’ কোনও ছবির শুটিং করতে যদি বিদেশে যেতে হয়, তা হলে ১০-১২ জন বা তারও বেশি সংখ্যক টেকনিশিয়ানকে কলকাতা থেকেই নিয়ে যেতে হবে কেন? ইউরোপে কাজ করতে যেতে হলেও কলকাতা থেকেই ইলেকট্রিশিয়ান সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে কেন? একটা নির্দিষ্ট সংগঠনের কাছ থেকেই গাড়ি ভাড়া নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকবে কেন? এমন একগুচ্ছ প্রশ্ন এ দিন তোলেন বাবুল।
আরও পড়ুন: নারদ-কাণ্ডে প্রথম গ্রেফতার, সোমবার পর্যন্ত সিবিআই হেফাজতে পুলিশ কর্তা এসএমএইচ মির্জা
তৃণমূল সাংসদ তথা টলিউডের জনপ্রিয় হিরো দেবের কয়েকটি টুইটের কথাও বাবুল এ দিন উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘‘বাংলা ছবি এখন হল পায় না। দেখলাম দেব একটা টুইটে সে কথা লিখেছেন। পরে দেখলাম, তিনি আরও একটা টুইট করেছেন এবং লিখেছেন যে, মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি সব জানিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী সমস্যার সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন।’’ বাবুলের প্রশ্ন, ‘‘কেন এই পরিস্থিতি হবে? কেন সব বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে হস্তক্ষেপ করতে হবে? সিনেমার মতো একটা বিষয়ও কেন মুখ্যমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে চলবে?’’
বাবুলের মূল নিশানা অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর দিকে ছিল না এ দিন। আসানসোলের বিজেপি সাংসদ তথা সঙ্গীতশিল্পীর অভিযোগ, ‘‘টলিউডে এখন ভিন্নমত পোষণ করার অধিকারই নেই কারও। কয়েকজন যা বলে দেবেন, তাতেই সবাইকে সম্মতি দিতে হবে। অসম্মতি জানালেই শুকনো পাতার মতো ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে।’’
কাদের কথা বলছেন বাবুল? কাদের কথায় সম্মতি দিতে সবাই বাধ্য হচ্ছেন? এ প্রশ্নের উত্তর তিনি সরাসরি দেননি। ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে ‘বিশ্বাস’ শব্দটা ব্যবহার করেছেন। আর বলেছেন, ‘‘আমি আর নামগুলো না-ই বা বললাম। আপনারা সবাই বুঝতে পারছেন, কাদের কথা বলছি। দুটো নাম রয়েছে।’’
বাবুল সুপ্রিয়র ইঙ্গিত যে অরূপ বিশ্বাস এবং স্বরূপ বিশ্বাসের প্রতিই, তা বুঝতে রাজনৈতিক শিবিরের অসুবিধা হয়নি। তাঁদের অনুগত হলে তবেই টলিউডে টিকে থাকা যাবে, না হলে কাজ মিলবে না— এই পরিস্থিতির অবসান ঘটানোই হবে খোলা হাওয়া-র মূল লক্ষ্য, জানান নতুন সংগঠনের নেতারা। স্বপন দাশগুপ্ত এই বার্তাও দেওয়ার চেষ্টা করেন যে, এই সংগঠন কোনও একটি নির্দিষ্ট দলের হয়ে কাজ করার জন্য তৈরি হচ্ছে না। শিল্পীরা স্বাধীন ভাবে কাজ করুন, এটা যাঁরা চান, তাঁদের প্রত্যেকের জন্যই এই সংগঠন— বলেন রাজ্যসভার ওই সাংসদ। স্বপনের কথায়, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে কোনও সাংস্কৃতিক ৩৭০ ধারা আমরা চলতে দেব না।’’
কারও নাম করা হয়নি ঠিকই। কিন্তু কলকাতা প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলন যে আসলে অরূপ-স্বরূপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, তা অনেকের কাছেই স্পষ্ট। ফলে বাবুলদের আক্রমণের জবাবও এ দিন দিয়েছেন স্বরূপ বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘‘শ্বাসরোধ কারা করছেন, সে কথা সকলে জানেন। সারা ভারতে শ্বাসরোধের পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। আমরা অনুরোধ করব, খোলা হাওয়ার নাম করে টালিগঞ্জের শিল্পী এবং টেকনিশিয়ানদের শ্বাসরোধটা আর করবেন না।’’
স্বরূপ যে অনুরোধই করুন, খোলা হাওয়া কিন্তু আপাতত সঙ্ঘাতের প্রহরই গুণছে। নতুন সংগঠনটির এক পদাধিকারীর কথায়, ‘‘সঙ্ঘাত তো অবধারিত। আমরা যাঁরা এই মঞ্চে হাজির হলাম, তাঁদেরকে পুরোপুরি কোণঠাসা করে ফেলার চেষ্টায় কোনও খামতি কি অরূপ-স্বরূপ রাখবেন? রাখবেন না। তাই সঙ্ঘাত শুরু হয়ে গেল বলেই ধরে নিতে পারেন।’’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ব্যাখ্যা একটু অন্য রকম। তাঁরা বলছেন, বাবুলরা যতই বলুন যে, শুধু শিল্পীদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতেই এই সংগঠন, আসল লক্ষ্য বিজেপির হাত শক্ত করা। আর টলিউডে তা করতে গেলে অরূপ-স্বরূপকে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা ওঁদের করতেই হবে।
কিন্তু তৃণমূলের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টাতেই তো এর আগে বঙ্গীয় চলচ্চিত্র পরিষদ বা ইআইএমপিসিসি-র মতো সংগঠন বিজেপির ছাতার তলায় তৈরি হয়েছিল। সেগুলোর কী হবে? এ দিনের সাংবাদিক সম্মেলনে বাবুল সুপ্রিয় জানান, ওই সংগঠনগুলি খোলা হাওয়া-র সঙ্গেই কাজ করবে, সব রকম ভাবে খোলা হাওয়া-কে সাহায্য করবে। খোলা হাওয়া-র তরফে শঙ্কুদেব পন্ডা ওই সংগঠনগুলির মধ্যে সমন্বয় রাখবেন বলে খবর। খুব তাড়াতাড়িই ওই সংগঠনগুলির নেতৃত্বকে নিয়ে শঙ্কুদেব বৈঠকে বসতে চলেছেন বলে জানা গিয়েছে।