মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রীর পদ ছেড়েছেন কম-বেশি ৭ বছর আগে। এখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু রেলমন্ত্রী হিসাবে মমতার ঘোষিত অনেক প্রকল্পই তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলেই আটকে পড়েছে। কোথাও সমস্যা জমির অভাব। আবার কোথাও সঙ্কট রেলের জমিতে জবরদখল। রেল সূত্রের খবর, এত দিনে এই জট কাটানোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে।
কী ভাবে?
তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় সদ্য সংসদের রেল বিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন। ওই দায়িত্ব পেয়েই তিনি দিল্লিতে রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে মিত্তল এবং কলকাতায় পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজারকে ডেকে পাঠিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলেছেন। রেল সূত্রের খবর, দু’জনকেই সুদীপবাবু বলেন, মমতা রেলমন্ত্রী থাকাকালীন পশ্চিমবঙ্গের জন্য বহু প্রকল্প ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তার মধ্যে অনেক প্রকল্পের কাজ শুরুই হয়নি। সেই জট এ বার খুলতে হবে। পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার সুদীপবাবুকে জানান, জমি এবং জবরদখল সমস্যায় প্রকল্পগুলির সিংহভাগ কাজ আটকে আছে। সুদীপবাবুর নির্দেশে আটকে থাকা প্রকল্পগুলির তালিকা তাঁকে জমাও দেন পূর্ব রেলের কর্তা। সুদীপবাবু তাঁদের আশ্বাস দিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর সম্মতি নিয়ে রেল ও রাজ্য প্রশাসনের কর্তাদের আলোচনায় বসিয়ে সমাধানের পথ বার করার চেষ্টা করা হবে।
রেলের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, ৮টি প্রকল্পের কাজ করা যাচ্ছে না হয় রেলের হাতে জমি নেই অথবা রেলের জমিতে বসে থাকা জবরদখলকারীদের সরানো যাচ্ছে না বলে। যেমন— ৭.৫৮৫ একর জমিতে রেল অধিকার কায়েম করতে ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে, আটকে রয়েছে আজিমগঞ্জ-মুর্শিদাবাদ নতুন রেল লাইনের ৪৬৬ মিটার অংশের কাজ। হুগলি এবং বাঁকুড়ায় রেলের ১৬১.৭৪ একর জমির মধ্যে জবরদখল থাকায় তারকেশ্বর-বিষ্ণুপুর নতুন রেল লাইনের কাজ আটকে পড়েছে। ভবদিঘি নামে একটি পুকুরকে ঘিরে স্থানীয় মানুষের বাধায় গোঘাট থেকে কামারপুকুর পর্যন্ত নতুন লাইনের কাজ হচ্ছে না। স্থানীয় মানুষের বাধায় একটি বেআইনি লেভেল ক্রসিং বন্ধ করতে না পারায় মথুরাপুর রোড এবং লক্ষ্মীকান্তপুর স্টেশনের মাঝখানে মাধবপুর হল্ট স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম বাড়ানো যাচ্ছে না। বালি স্টেশনে জবরদখল করে মাছের বাজার গড়ে ওঠায় ডানকুনি-বালি থার্ড লাইনের কাজ বাধা পাচ্ছে। আজিমগঞ্জ সিটি স্টেশনে ২৪২টা জবরদখলকারী দোকানের জন্য ব্যাহত হচ্ছে আজিমগঞ্জ সিটি-মণিগ্রাম ডবল লাইনের কাজ।
প্রসঙ্গত, মমতা দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বার বার সরকারি জমি থেকে জবরদখলকারীদের উচ্ছেদের কথা বলছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, সরকারি জমি থেকে জবরদখল সরাতে না পারলে কোনও ধরনের উন্নয়ন প্রকল্পই সম্ভব নয়। সড়ক পরিবহণ ও জাহাজমন্ত্রী হয়ে নিতিন গডকড়ী বহু বার বলেছেন, জবরদখলকারীদের জন্যই এ রাজ্যে রাস্তা সম্প্রসারণের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। সমস্যার কথা জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দেন গডকড়ী। পরে মমতার সঙ্গে তিনি দেখাও করেন। রাজ্য জমি না দিলে সাগরে প্রস্তাবিত গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য সড়ক নির্মাণ ও রেল লাইন পাতার কাজ করা যাবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন বন্দর কর্তৃপক্ষ।
রাজনৈতিক শিবিরের অবশ্য প্রশ্ন, মমতা যতই জবরদখল সরানোর কথা বলুন, বাস্তবে তার রূপায়ণ কি ঘটবে? কারণ, এখনও পর্যন্ত রাজ্যের কোথাও সরকারি জমি থেকে জবরদখল সরানোর কোনও উদ্যোগ চোখে পড়েনি। মমতা সরকারের ঘোষিত অবস্থানই হল, জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা হবে না। তাই যে সব প্রকল্পের জমি রেলের হাতে নেই, সেগুলির ভবিষ্যৎ নিয়ে আরও চিন্তায় রয়েছেন বোর্ডের কর্তারা। তৃণমূল সূত্রের মতে, জবরদখলকারীদের সরাতে হলে একমাত্র রফাসূত্র বেরোতে পারে রেল তাঁদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিলে। তবে সেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখতে হবে রাজ্য সরকারকেই। আর জমির অভাব মেটাতে হলেও রাজ্যকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সুতরাং, রেল প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে রাজ্য সরকারের সদিচ্ছার উপরে।
সুদীপবাবু রেলের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার পর সোমবারই দিল্লিতে ওই কমিটির প্রথম বৈঠক হয়েছে। সেখানে যাত্রী নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ানো, স্টেশনের আধুনিকীকরণ ও ক্যাটারিং পরিষেবা চালু করা, পর্যটন-বান্ধব এবং তীর্থক্ষেত্রগুলির মধ্যে রেল যোগাযোগ তৈরি, দ্রুত গতির ট্রেন চালু করা-সহ এক গুচ্ছ কাজ আগামী এক বছরের মধ্যে করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। সব থেকে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে নিরাপত্তার বিষয়ে। সুদীপবাবু এ দিন কমিটির সদস্যদের জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছরে রেল বাজেটে ঘোষিত প্রকল্পগুলির অবস্থা খতিয়ে দেখতে তিনি বৈঠক ডাকবেন।