বন্‌ধে পাহাড়, চা বাগান স্বাভাবিক, ভুগল সমতল

কংগ্রেসের ডাকা বাংলা বন্‌ধের জেরে মঙ্গলবার দিনভর উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়। দার্জিলিং পাহাড়ের ৩ মহকুমা, তরাই-ডুয়ার্সের চা বলয়ে অবশ্য বন্‌ধের কোনও প্রভাব সে ভাবে পড়েনি। ট্রেন চলাচল মোটামুটি ঠিকঠাক ছিল।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৫ ০২:৫৮
Share:

মালদহে কংগ্রেসের ডাকা বন্‌ধে সাংসদ মৌসম বেনজির নুর।

কংগ্রেসের ডাকা বাংলা বন্‌ধের জেরে মঙ্গলবার দিনভর উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়। দার্জিলিং পাহাড়ের ৩ মহকুমা, তরাই-ডুয়ার্সের চা বলয়ে অবশ্য বন্‌ধের কোনও প্রভাব সে ভাবে পড়েনি। ট্রেন চলাচল মোটামুটি ঠিকঠাক ছিল। সব বাগানেই কাজকর্ম ছিল প্রায় স্বাভাবিক। সরকারি অফিসগুলিতে হাজিরার হারও ছিল প্রায় স্বাভাবিক। তবে স্কুল-কলেজ খোলা থাকলেও অনেক জায়গায় বেশি পডুয়ার দেখা মেলেনি।

Advertisement

বন্‌ধে তুলনামূলক ভাবে জনজীবন প্রায় স্তব্ধ হয়ে যায় এখন রাজ্য রাজনীতিতে কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত মালদহ ও উত্তর দিনাজপুরে। রায়গঞ্জে বন্‌ধ সমর্থনকারী কংগ্রেস সমর্থকদের উপর লাঠি সোটা ও রড নিয়ে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র একদল সমর্থকের বিরুদ্ধে।

মঙ্গলবার বেলা ১২টা নাগাদ ঘটনাটি ঘটেছে রায়গঞ্জের কর্ণজোড়া পুলিশ ফাঁড়ির অদূরে সার্কিট হাউসের সামনে। সে সময়ে তৃণমূল প্রভাবিত সংগঠনের দিকে থাকা এক যুবককে পিস্তল উঁচিয়ে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়। কংগ্রেসের অভিযোগ, আইএনটিটিইউসি-র সমর্থক ওই যুবক কংগ্রেস সমর্থকদের গুলি করে খুনের হুমকি দিচ্ছিলেন।

Advertisement

পিস্তল উঁচিয়ে হুমকি

যে এলাকায় কংগ্রেস সমর্থকদের উপর হামলার ঘটনাটি ঘটে সেখান থেকে ১০০ মিটারের মধ্যে উত্তর দিনাজপুরের জেলাশাসক ও পুলিশ সুপারের দফতর। রয়েছে জেলা পরিষদও। ফলে বন্‌ধকে কেন্দ্র করে কোনও গোলমাল রুখতে ওইদিন প্রশাসনিক ভবন লাগোয়া ওই এলাকায় বিরাট পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছিল। পুলিশের সামনেই কংগ্রেস সমর্থকদের উপর হামলা চালানো হয় বলে কংগ্রেসের অভিযোগ।

হামলায় জখম হয়েছেন কংগ্রেসের সাত সমর্থক। ভাঙচুর করা হয় কংগ্রেস সমর্থকদের চারটি মোটর বাইকও। জখমদের নাম বিষ্টুচন্দ্র বর্মন, সোলেমান মহম্মদ, কার্তিকচন্দ্র মিঞ্জ, চন্দন দাস, শুক্রু বর্মন, সত্যেন বর্মন ও অজিতচন্দ্র বর্মন। বিষ্টুবাবু রায়গঞ্জের কমলাবাড়ি ২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। চন্দনবাবু ওই পঞ্চায়েতেরই কংগ্রেস সদস্য। জখমদের মধ্যে শুক্রুবাবু, সোলেমানবাবু, কার্তিকবাবু ও অজিতবাবুকে রায়গঞ্জ জেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। বাকিদের প্রাথমিক চিকিত্সার পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। শুক্রুবাবুর মাথা ফেটে গিয়েছে। ওই ঘটনার পরে কংগ্রেসের নেতা কর্মীরা কর্ণজোড়া পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে আইএনটিটিইউসি-র অভিযুক্ত সমর্থকদের গ্রেফতারের দাবি জানান। পুলিশের আশ্বাসের পরে তাঁরা ফিরে যান।

জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা রায়গঞ্জের বিধায়ক মোহিত সেনগুপ্তের অভিযোগ, ‘‘হামলা চলাকালীন আইএনটিটিইউসি-র এক যুবক পিস্তল উঁচিয়ে কংগ্রেস সমর্থকদের খুনের হুমকি দিয়ে পুলিশের সামনেই সঙ্গীদের নিয়ে পালিয়ে যায়।’’

জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা ইটাহারের বিধায়ক অমল আচার্যের দাবি, ‘‘যে সমস্ত দুষ্কৃতী এদিন আগ্নেয়াস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে কংগ্রেস সমর্থকদের উপর হামলা চালিয়েছে তারা কেউই তৃণমূলের কর্মী বা সমর্থক নয়। সংবাদমাধ্যমের সামনে অভিনয় হয়েছে।’’

উত্তর দিনাজপুরের পুলিশ সুপার সৈয়দ ওয়াকার রেজা বলেন, ‘‘পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন। পুলিশ আইন মেনেই কাজ করেছে। পুলিশের কাছে এখনও কোনও হামলার অভিযোগ জমা পড়েনি। অভিযোগ পেলে তা খতিয়ে দেখে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’ তিনি জানান, জোর করে বন্‌ধ সফল করার চেষ্টার অভিযোগে এদিন জেলার নয়টি থানা এলাকা থেকে ৩৮ জন বন্‌ধ সমর্থনকারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

এ দিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুক্রুবাবু বলেন, ‘‘মোহিতবাবুর নির্দেশে আমরা পিকেটিং করে বাইকে চেপে বাড়ি ফিরছিলাম। সেই সময় আইএনটিটিইউসি-র সমর্থকেরা প্রশাসনিক ভবন চত্বরে সংগঠনের পতাকা লাগানো একাধিক বাইকে চেপে আমাদের আটক করে লোহার রড ও লাঠিসোটা নিয়ে আমাদের বেধরক মারধর করে। আইএনটিটিইউসি-র এক সমর্থক আমাদের পিস্তল দেখিয়ে খুনের হুমকি দেয়। আমদের বাইকগুলি ভাঙচুর করা হয়। সমস্ত ঘটনা পুলিশের সামনে হয়েছে। প্রাণ বাঁচাতে আমরা পালিয়ে যাই।’’

হেনস্থার নালিশ

মালদহে বেসরকারি বাস, দোকান বন্ধ থাকলেও সরকারি বাস চলাচল ছিল স্বাভাবিক। ট্রেন চলাচলে তেমন প্রভাব পড়েনি। মালদহে অবরোধ কর্মসূচিতে উপস্থিত ছিলেন জেলা কংগ্রেসের সভানেত্রী তথা সাংসদ মৌসম নুর, সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী, বৈষ্ণবনগরের বিধায়ক ইশা খান চৌধুরী সহ একাধিক নেতৃত্বেরা। সাংসদ তথা জেলা কংগ্রেসের সভানেত্রী মৌসম নুরকে পুলিশ কর্মীরা হেনস্থা করে বলে অভিযোগ। এদিনই দলীয় কার্যালয়ে সাংবাদিক বৈঠক করেন সভানেত্রী তথা সাংসদ মৌসম নুর। তিনি বলেন, ‘‘পুলিশ যে ভাবে আমাদের মহিলা কর্মী এবং আমাকে ধাক্কাধাক্কি করল তার প্রতিবাদ জানাই। শান্তিপূর্ণ মিছিলকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার অভিষেক মোদির নেতৃত্বে পুলিশ ইচ্ছাকৃত ভাবে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি করে আমাদের কর্মীদেরকে হেনস্থা করার প্রতিবাদে আগামী ৩১ অগস্ট জেলা পুলিশ সুপারের অফিস ঘেরাও করা হবে। সাংসদেও বিষয়টি নিয়ে জানানো হবে।’’

হয়রান নিত্যযাত্রীরা

কংগ্রেসের ডাকা বাংলা বন্‌ধে যানবাহনের অভাবে নাকাল হতে হল নিত্যযাত্রীদের। বেসরকারি যানবাহন না চলায় সরকারী বাসই ভরসা ছিল যাত্রীদের। এদিন সরকারি অফিস খোলা থাকলেও অনেক কর্মী আসতে পারেননি। আলিপুরদুয়ারে বনধ সফল হয়েছে বলে দাবি করল কংগ্রেস নেতৃত্ব। এদিন সকাল বেলয়া পথে নেমে বন্‌ধ করতে দেখা যায় কংগ্রেস নেতা কর্মীদের। পরে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে আলিপুরদুয়ার থানায় নিয়ে যায়। দুপুররে দিকে ব্যক্তিগত বন্ডে তাদের ছেড়ে দেয় পুলিশ।

জলপাইগুড়ি জেলায় কংগ্রেসের ডাকা বনধের মিশ্র প্রভাব পড়েছে। জলপাইগুড়ি শহরে বিভিন্ন সরকারি অফিস, ব্যাঙ্ক, ডাক ঘর, জেলা দায়রা আদালত খোলা থাকলেও ব্যস্ততম দিনবাজার, স্টেশন বাজার, ডিবিসি রোড, কদমতলা, পোস্ট অফিস মোড়ের বেশির ভাগ দোকান ছিল বন্ধ। রাস্তা ছিল সুনসান। কিছু রিকশা চলাচল করলেও রাস্তায় বেসরকারি বাস এবং অটো নামেনি।

কোচবিহারে কংগ্রেসের সংগঠন প্রায় নেই বললেই চলে। কর্মী-সমর্থক হাতে গোনা। সকাল সাড়ে ৯ টা নাগাদ কংগ্রেস জেলা সভাপতি শ্যামল চৌধুরীর নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল মিছিল বের করে। সাগর দিঘির পাড় হয়ে মিছিল কোচবিহার শহরের বেশ কয়েকটি রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। অভিযোগ, দোকানপাট বন্ধ করে দিতে হুমকি দেয় তাঁরা।

ধৃত শঙ্কর, সুজয়

এদিন শিলিগুড়িতে কংগ্রেসের প্রাক্তন কাউন্সিলর থেকে জেলার নেতারা এলাকায় এলাকায় এদিন সকাল থেকে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। জেলা কংগ্রেসের দুই শিবিরের নেতা বলে পরিচিত বিধায়ক শঙ্কর মালাকার এবং পুরসভায় পরি‌ষদীয় নেতা সুজয় ঘটককে সকাল থেকে একসঙ্গে রাস্তায় দেখা যায়।

মিছিল, পিকেটিং করার সময় দুই জনকে একসঙ্গে পুলিশ গ্রেফতারও করে। বনধ সফল করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছেন পুরসভার কাউন্সিলর পিন্টু ঘোষ থেকে শুরু করে প্রাক্তন কাউন্সিলর তপন দত্তও। পাড়ার বাজারগুলিও সকাল থেকে বনধ করার জন্য সক্রিয় ছিলেন নেতারা।

মহকুমার অন্যতম বড় হাট বলে পরিচিত হাট মাটিগাড়া হাটের ‘হাটবারে’ এদিন তুলনামূলকভাবে লোকজন কম ছিল। ফাঁসিদেওয়া, বাগডোগরা, নকশালবাড়ি, খড়িবাড়িতে বন্‌ধ হয়েছে। কয়েকটি এলাকায় বনধের সমর্থন বাইক মিছিলও করেছেন কংগ্রেসিরা। বাগডোগরা বিমানবন্দর স্বাভাবিক ছিল। দিনভর ১৩টি বিমান ওঠানামা করেছে। ভোর ছয়টা থেকে রেস্তোরাঁ, টার্মিনাল ভবন এবং প্রিপেড পার্কিং খোলা ছিল। আগের বন্‌ধের মতো এ বার বিমানযাত্রীদের বাগডোগরাতেই থাকতে হয়নি।

ছবিগুলি তুলেছেন হিমাংশুরঞ্জন দেব, দীপঙ্কর ঘটক, মনোজ মুখোপাধ্যায়, গৌর আচার্য ও বাপি মজুমদার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement