Gangasagar Mela 2025

পুণ্যলোভীর ভিড়ে অন্য পুতুলনাচের ইতিকথা

নাতিশীতোষ্ণ পৌষের সকালে মকর সংক্রান্তির শাহি স্নান সেরে বিবিধ ভাষায় ক্যাচর-ম্যাচর সহযোগে কপিল মুনির আশ্রমের দিকে এগিয়ে চলেছে এক ‘খুদে ভারতবর্ষ’। ব্যারিকেড-জর্জর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সেই ভিড়ের দিকে হাত নাড়ছেন ৬২ বছরের এক প্রৌঢ়।

Advertisement

সম্রাট মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ০৬:৫৭
Share:

গঙ্গাসাগরে মকর সংক্রান্তির শাহি স্নানে আশি ছুঁই ছুঁই বৃদ্ধা। মঙ্গলবার। ছবি: সুদীপ ঘোষ।

এ-ও এক পুতুলনাচ। এরও আছে এক ইতিকথা।

Advertisement

নাতিশীতোষ্ণ পৌষের সকালে মকর সংক্রান্তির শাহি স্নান সেরে বিবিধ ভাষায় ক্যাচর-ম্যাচর সহযোগে কপিল মুনির আশ্রমের দিকে এগিয়ে চলেছে এক ‘খুদে ভারতবর্ষ’। ব্যারিকেড-জর্জর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে সেই ভিড়ের দিকে হাত নাড়ছেন ৬২ বছরের এক প্রৌঢ়।

একটু ভুল হল। হাত-পা নাড়ছে আসলে হাওয়া ভরা এক অতিকায় বিজ্ঞাপনী ম্যাসকট। সেই পুতুলেরই অন্তঃসারশূন্য অন্তরে ‘বন্দি’ ছোটখাটো চেহারার, শীর্ণকায় কার্তিক মণ্ডল। শান্তিপুরের তাঁতশিল্পী কার্তিক অবশ্য এই বন্দিদশা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন। কার্তিক একা নন, তাঁর মতো জনা চার-পাঁচ তখন পুণ্যার্থীদের আকর্ষণের কেন্দ্রে। বাচ্চা থেকে বুড়ো, কেউ এসে পুতুলের কান মলে দেখছেন, সে চেঁচায় কিনা। কেউ বা পেটে আলতো করে কিল মেরে বোঝার চেষ্টা করছেন, ভিতরে নাড়িভুঁড়ির বদলে কী ভরা আছে। কেউ আবার মাথায় একটু তবলা বাজিয়ে চলে যাচ্ছেন। এক কিশোর ল্যাং মারতে যাওয়ায় এ বার হাঁই হাঁই করে আঁতকে উঠলেন কার্তিক— ‘‘আরে আরে, ভাই অ্যায়সা মত করো, অ্যায়সা মত করো। পুরা গির জাউঙ্গা।’’ বংশপরম্পরায় তাঁতশিল্পী কার্তিকের বাড়িতেই রয়েছে নিজস্ব তাঁতকল। কিন্তু ব্যবসায় এমনই ভয়াবহ মন্দার ছায়া যে, সংসার চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অগত্যা, বয়নশিল্প সরিয়ে রেখে পেটের দায়ে পুতুলের পেটে ঢুকে পড়েছেন কার্তিক। যেমন ঢুকেছেন তাঁরই গ্রামের বাসিন্দা, ৬৩ বছরের দুলাল দাস। দুলালেরও কাহিনি প্রায় এক। প্রবল অর্থাভাবই পুতুলের পেটে ঠেলে দিয়েছে তাঁকে। কার্তিকের পাশে হাঁটছে আরও একটি হাওয়াভরা পুতুল, যার মধ্যে বন্দি দুলাল তখন আত্মরক্ষা আর মনোরঞ্জনের এক বিচিত্র জাগলিংয়ে ব্যস্ত।

Advertisement

করোনা-কালে চিকিৎসকদের পিপিই কিট দেখেছেন কখনও? কার্তিক দেখেননি। তাঁকে জানানো গেল, তাঁর এই পুতুল-পোশাক অনেকটাই সেই পিপিই কিটের মতো। এখন তো ঠান্ডা বিশেষ নেই। তার উপরে চার দিক বন্ধ। আপনার কষ্ট হয় না?

মায়ের কোল থেকে মুন্ডু বাড়িয়ে ‘‘উয়ো দেখো দানো (দানব)’’ বলে হাত বাড়ানো, ফোকলা হাসি বার করা এক শিশুর দিকে টা-টা করতে করতে কার্তিক বলেন, ‘‘গরমকালে খুব কষ্ট হয়। ভিতরে তো হাওয়া ঢোকে না। জল খাওয়া, বাথরুম যাওয়া, সব বন্ধ। কী করব বলুন। এই কাজ করতে গেলে, এটুকু কষ্ট তো হবেই।’’

কে দিল এই কাজ? উত্তর দেওয়ার আগেই পুলিশের হুড়ো খেয়ে একটু এগিয়ে গেলেন কার্তিক। পিছন থেকে গুরুগম্ভীর আওয়াজ তুলে এক সরকারি কর্তার পেল্লায় এসইউভি আসছে বিস্তর ধুলো উড়িয়ে। রাস্তার এক ধার ঘেঁষে কার্তিক দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘আমাদের মালিক শান্তিপুরেরই লোক। দিনে সাত-আট ঘণ্টা মিকি মাউস সাজলে হাজার দেড়েক টাকা মতো আসে। তবে, একটানা তো পারি না। তা হলে অসুস্থ হয়ে পড়ব। দেড়-দু’ঘণ্টা করে কয়েক দফায় করি।’’

স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে ভরা সংসার কার্তিকের। তাঁর কথায়, ‘‘বাড়ির তাঁতকল এখন ওরাই চালায়। যেটুকু আয় হয়, সংসার চলে না। কাঁচামালের দাম বেড়েছে অনেক। অন্য সরঞ্জামের দামও বেড়ে চলেছে। বংশের ব্যবসা লাটে উঠেছে প্রায়। আমাদের বাঁচার আর কোনও উপায় রাখেনি।’’ প্রশাসনের কোনও সাহায্য...? প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই হাওয়ায় ফোলানো দানবীয় দু’টো হাত আকাশপানে তোলেন কার্তিক। কী বলতে চান, খোলসা করেন না।

শাহি স্নান শেষে এ বার ফেরার পালা সকলের। স্লগ ওভারে চালিয়ে খেলার পরে দেখা গেল, অন্যান্য বারের মতো না হলেও কিছু ভিড় জোগাড় হয়েছে সাগরমেলার স্কোরবোর্ডে। রাস্তার ধারে শাড়ির দু’প্রান্ত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন মধ্যপ্রদেশের অমরকণ্টকের বাসিন্দা গুড্ডি ঝারিয়া ও বিমলা ঝারিয়া। সম্পর্কে তাঁরা বেয়ান। স্নানের পরে ভেজা শাড়ি শুকোচ্ছেন ওই ভাবে। বিরাট দল নিয়ে এসেছেন তীর্থে।

বাড়ি ফেরা কবে? গুড্ডি বললেন, ‘‘আরে, এখনই ফিরব না আমরা। এখান থেকে যাব পুরী। তার পরে কুম্ভমেলা। তার পরে বাড়ি।’’ আনন্দে চোখ চকচক করে দুই বেয়ানের।

সংক্রান্তির দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে। ধীরে ধীরে ফাঁকা হতে থাকে সাগরমেলা চত্বর। বিদায়ী অনেকেরই ব্যাগে প্রয়াগরাজের টিকিট। তা হলে কি কুম্ভ এ বার আরও একটু পূর্ণ হওয়ার পথে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement