রাজ্য পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের ডাকা সেই দরপত্র। নিজস্ব চিত্র
পুরনো গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে নতুন নয়। আগে একাধিক বার এ নিয়ে সরব হয়েছেন পরিবেশকর্মীরা। তবে এ বার ফের নতুন করে বিতর্কের কেন্দ্রে রাজ্য পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের ডাকা একটি দরপত্র। যেখানে দফতরের ‘সল্টলেক কনস্ট্রাকশন ডিভিশন’-এর এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের অফিসের দৈনন্দিন ব্যবহারে পুরনো গাড়ি ভাড়া নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে পরিবেশকর্মীদের একাংশের অভিযোগ, এখানে তো নিয়ম প্রণয়নকারীরাই নিয়মভঙ্গকারী। এ নিয়ে শোরগোল শুরু হতে দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
দফতর সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এক বছরের মেয়াদে ডিজ়েলচালিত একটি ম্যাক্সি-ক্যাব ভাড়া নেওয়া হবে। সেই ক্যাবের ধোঁয়া থেকে বায়ুদূষণ মাপার মাপকাঠি ভারত স্টেজ-৩ বা ভারত স্টেজ-৪ হওয়া প্রয়োজন। তা-ও ভারত স্টেজ-৪ বাধ্যতামূলক নয়। এক পরিবেশকর্মীর কথায়, ‘‘বিজ্ঞাপনের ভাষায় এমন ভাবে ভারত স্টেজ-৪-এর কথা বলা হয়েছে যে পড়ে মনে হচ্ছে, হলে ভাল। না হলেও কোনও অসুবিধা নেই। সেই কারণে ব্র্যাকেটে ‘প্রেফারেবল’ লেখা।’’
প্রসঙ্গত, গাড়ির ধোঁয়া থেকে বায়ুদূষণের মাপকাঠি হল ‘ভারত স্টেজ’ (বিএস)। ২০০০ সালে শূন্য থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে বেড়েছে এই মাপকাঠি। ২০১০ সালের ১ এপ্রিল থেকে দেশের ১৩টি শহরে বিএস-৪ বিধি চালু হয়েছে। ২০১৭-র এপ্রিল থেকে দেশে সব ধরনের
গাড়ির জন্যই তা চালু হয়েছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য নতুন মাপকাঠিতে গাড়ি থেকে নির্গত ধূলিকণার ও নাইট্রোজেন অক্সাইডের মাত্রা আরও আঁটোসাঁটো হয়েছে। তার পরেও সরকারি দফতরের ভাড়া গাড়ির ক্ষেত্রে ভারত স্টেজ-৩ উল্লেখ থাকায় বিস্মিত অনেকেই। পরিবেশ গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’-এর এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যাডভোকেসি) অনুমিতা রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘নতুন গাড়ির পরিবর্তে পুরনো গাড়ি ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। তা হলেও বিএস-৪ বা বিএস-৬ উল্লেখ করতে হত। বিএস-৩ অনেক পুরনো। কলকাতায় এত পুরনো গাড়ি চলার কথা নয়।’’
অথচ, ২০১৮ সালের অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল, ২০২০ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে বিএস-৪ মাপকাঠির গাড়ি দেশের কোথাও বিক্রি বা তার রেজিস্ট্রেশন করানো যাবে না। কারণ, দেশে দূষণের মাত্রা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ‘ফেডারেশন অব অটোমোবাইল ডিলার্স অ্যাসোসিয়েশন’ জানিয়েছিল, তারা বিএস-৬ মাপকাঠি মানতে রাজি। তবে এত স্বল্প সময়ে সমস্ত বিএস-৪ গাড়ির রেজিস্ট্রেশন এবং বিভিন্ন ডিলারের কাছে পড়ে থাকা অবিক্রীত গাড়ি আর বিক্রি করা যাবে না। তাই পুরনো মাপকাঠি মেনে তৈরি গাড়ি বিক্রির সময়সীমা বাড়াতে আর্জি জানায় গাড়ি সংস্থাগুলি। যাতে মজুত ভান্ডার খালি করা যায়।
পরিসংখ্যান দিয়ে সেই সময়ে ফেডারেশন জানিয়েছিল, ১০৫০০০ দু’চাকা, ২২৫০ যাত্রিবাহী গাড়ি এবং ২০০০ বাণিজ্যিক গাড়ি বিক্রি হয়েছে, অথচ সেগুলির রেজিস্ট্রেশন হয়নি তখনও। তা ছাড়া, আরও সাত লক্ষ দু’চাকা, ১৫ হাজার যাত্রিবাহী গাড়ি এবং ১২ হাজার বাণিজ্যিক গাড়ি অবিক্রীত অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
এক পরিবেশকর্মীর কথায়, ‘‘ঠিক হয়েছিল, যে গাড়িগুলি ইতিমধ্যেই রাস্তায় নেমেছে, ধাপে ধাপে পুরোপুরি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত সেগুলি চলবে। তার মানে এই নয় যে, বিএস-৩ গাড়ি চলবে!’’ আর এক পরিবেশকর্মী বলছেন, ‘‘যেখানে বিএস-৪ মাপকাঠির গাড়ি চলাচলের উপরেই প্রাথমিক ভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল শীর্ষ আদালত, সেখানে বিএস-৩ মাপকাঠির গাড়ি চলা মানে পিছনের দিকে হাঁটা!’’ পুরনো গাড়ি নিয়ে জাতীয় পরিবেশ আদালতে মামলার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় সড়ক ও হাইওয়ে মন্ত্রক জানিয়েছিল, কলকাতার রাস্তায় চলা পুরনো বাণিজ্যিক গাড়ির সংখ্যা প্রায় দু’লক্ষ এবং অ-বাণিজ্যিক গাড়ির সংখ্যা প্রায় ১৮ লক্ষ। পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত বলছেন, ‘‘দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে পুরনো গাড়ি বাতিলের মামলা চলছে। তার এখনও সমাধান হল না।’’
বিষয়টি জানতে পেরে পুর ও নগরোন্নয়ন দফতরের এক শীর্ষ কর্তার বক্তব্য, ‘‘সংশ্লিষ্ট ডিভিশনের ডাকা দরপত্রটি বাতিল করা হবে।’’