পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র
ইস্তফা নেননি ৯ অগস্ট। আগে তদন্ত শেষ হোক, তার পরে উচ্চশিক্ষা দফতরের পদক্ষেপ পছন্দ না হলে ইস্তফা দেবেন— মিল্লি আলআমিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে সে দিন এই বার্তাই দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু ২০ অগস্ট ছবিটা নিঃশব্দে বদলে গিয়েছে বলে খবর। কলেজের পরিচালন সমিতিকে বৈশাখীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে।
১৪ অগস্ট নয়াদিল্লিতে বিজেপির সর্বভারতীয় সদর দফতরে স্বাগত জানানো হয় কলকাতার প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এবং কলেজ শিক্ষিকা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে। খানিকটা বিস্ময় জাগিয়ে পরবর্তী এক সপ্তাহে দলীয় বিধায়ক তথা কাউন্সিলর শোভনের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ তৃণমূল করেনি। শোভনের দলবদল নিয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব সাঙ্ঘাতিক তীব্র প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে, এমনও দেখা যায়নি। শোভনদের দলবদলে তৃণমূল যে একেবারেই বিব্রত নয়, সম্ভবত সেটাই বোঝাতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু দলীয় স্তর থেকে পদক্ষেপ হোক বা না হোক, শোভন-বৈশাখীকে অখণ্ড স্বস্তিতে থাকতে দেওয়া হবে, এমনটাও যে ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই, তা এ বার ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করল।
২০ অগস্ট অর্থাৎ মঙ্গলবার প্রথম বারের জন্য রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে পা রাখেন শোভন ও বৈশাখী। আর মিল্লি আলআমিন কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি আমিরুদ্দিন ববিও ওই মঙ্গলবারই শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে বার্তা পান বৈশাখীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার বিষয়ে। খবর উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের।
কলেজে তাঁকে হেনস্থা করা হচ্ছে, শাবিনা নিশাত ওমর নামে এক শিক্ষিকাকে কাজে লাগিয়ে তাঁকে অপদস্থ করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে— ৭ অগস্ট সাংবাদিক সম্মেলন করে এই অভিযোগই তুলেছিলেন বৈশাখী। শোভন চট্টোপাধ্যায়কে কিছুতেই তৃণমূল বাগে আনতে পারছে না বলেই তাঁকে (বৈশাখীকে) হেনস্থা করে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টা হচ্ছে— এমনই অভিযোগ ছিল মিল্লি আলআমিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষার। সেই সাংবাদিক সম্মেলনে বৈশাখীর পাশে বসে শোভনও প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে।
আরও পড়ুন: ২৬ অগস্ট পর্যন্ত চিদম্বরমের সিবিআই হেফাজতের নির্দেশ আদালতের
পাল্টা সাংবাদিক বৈঠক ডাকতে হয়েছিল পার্থকেও। তবে তিনি বৈশাখী বা শোভনকে পাল্টা আক্রমণ করেননি সে দিন। চক্রান্তের তত্ত্ব নস্যাৎ করেছিলেন। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর কাছে অভিযোগ জানালে তিনি অবশ্যই পদক্ষেপ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ বৈশাখী তুলেছেন, তাতে তিনি ‘ব্যথিত’ বলেও শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন।
এর পরে ৯ অগস্ট পার্থর বাড়ি গিয়ে তাঁর হাতে ইস্তফাপত্র তুলে দেন বৈশাখী। নিজের অভিযোগের কথা যে চিঠিতে লিখেছিলেন তিনি, সেই চিঠির শেষেই ইস্তফার কথা লেখা ছিল। তাই পার্থ চট্টোপাধ্যায় সেই চিঠি প্রথমে গ্রহণ করতে চাননি। পরে চিঠিটি নেন এবং জানান যে, তিনি শুধু অভিযোগটাই গ্রহণ করছেন, ইস্তফাটা নয়। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত হবে এবং অপরাধ প্রমাণিত হলে শাবিনা নিশাত ওমরের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে— এমন আশ্বাসও পার্থবাবু দিয়েছিলেন। কিন্তু রাজ্য বিজেপির সদর দফতরে শোভন-বৈশাখীর পদার্পণের দিনেই সমীকরণ অনেকটা বদলে গিয়েছে বলে জানা যাচ্ছে।
উচ্চশিক্ষা দফতর সূত্রের খবর, মঙ্গলবার শহরের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কর্মসূচি ছিল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের। সেখানেই তিনি ডেকে নিয়েছিলেন মিল্লি আলআমিন কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি তথা কলকাতা পুরসভার অন্যতম মেয়র পারিষদ আমিরুদ্দিন ববিকে। কলেজের যে শিক্ষিকার বিরুদ্ধে বৈশাখীর অভিযোগ, সেই শাবিনা নিশাত ওমরের যাতে আপাতত কোনও সমস্যা না হয়, সে দিকে নজর রাখার বার্তাও আমিরুদ্দিন পান বলে খবর। ইস্তফা তথা অভিযোগপত্র পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে জমা দেওয়ার পর থেকে বৈশাখী আর কলেজে যাননি। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষার সেই অনুপস্থিতি এবং শাবিনার তোলা নানা অভিযোগের প্রেক্ষিতে বৈশাখীর বিরুদ্ধে এ বার পরিচালন সমিতি পদক্ষেপ করুক— এই বার্তাও দিয়ে দেওয়া হয় বলে জানা গিয়েছে।
আরও পড়ুন: অসহযোগিতা করিনি, সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি, কোর্টে নিজেই বললেন চিদম্বরম
বৈশাখীর কলেজ নিয়ে আরও একটি পদক্ষেপ পার্থ চট্টোপাধ্যায় করেছেন। মিল্লি আলআমিন কলেজ ২০১৬ সালের আগে পর্যন্ত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কলেজ হিসেবে বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিল। পরে সে তকমা কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু পরিচালন সমিতির অনুরোধে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা বৈশাখী সেই তকমা ফিরিয়ে আনতে সক্রিয় হন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে অনেক বারই তিনি দরবার করেন বিষয়টি নিয়ে। কিন্তু কাজ হয়নি। এ বার কিন্তু কাজ হল। মিল্লি আলআমিন কলেজকে ‘সংখ্যালঘু’ তকমা ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন পার্থ।
উচ্চশিক্ষা দফতরের এই সিদ্ধান্ত বা বৈশাখীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপের নির্দেশ সম্পর্কে যে কথা শোনা যাচ্ছে, সে বিষয়ে জানতে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে ফোন করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফোন কেটে দেন। ফোন ধরেননি আমিরুদ্দিন ববিও।
বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু মুখ খুলেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘কলেজটা যে এলাকায়, সেখানকার বাসিন্দাদের ভাবাবেগের কথা মাথায় রেখে আমি অনেক দিন ধরেই ‘সংখ্যালঘু’ তকমা দেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছিলাম। কিন্তু উচ্চশিক্ষা দফতর কিছুতেই রাজি হয়নি। আমি বিজেপিতে যোগ দেওয়ার পরেই কলেজটা ‘সংখ্যালঘু’ তকমা ফিরে পেয়ে গেল। উদ্দেশ্য বুঝতে কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।’’
কিন্তু যে সব অভিযোগ তিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কাছে জমা দিয়েছিলেন, সে সবের তদন্ত সম্পর্কে কী ভাবছেন এখন? বৈশাখীর জবাব, ‘‘তদন্ত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে পার্থবাবু আমাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরে তো প্রায় দু’সপ্তাহ কাটতে চলল। তদন্ত এগোল, নাকি আদৌ এগোল না, কিছুই জানতে পারিনি।’’ বৈশাখীর কটাক্ষ, ‘‘এ বার তদন্ত এগোবে বলে আশা করছি। কোন পথে এগোবে, তা-ও আঁচ করতে পারছি।’’