প্রতীকী ছবি।
জীবনযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে ক্ষত সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে করোনা শিক্ষায় সব থেকে বড় আঘাত হেনেছে বলে শিক্ষা শিবিরের পর্যবেক্ষণ। এই অবস্থায় শিক্ষার দেড় বছরেরও বেশি সময় বন্ধ থাকার পরে স্কুল আংশিক খুললেও বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ইঙ্গিত দিয়েছেন, করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকলে স্কুল-কলেজ আবার কিছু দিনের জন্য বন্ধ করতে হবে। শিক্ষাসচিব মণীশ জৈনকে মমতার এই নির্দেশের পরে প্রশ্ন উঠছে, সর্বস্তরের পঠনপাঠনের কী হবে? সর্বোপরি কী হবে পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্যের?
এখন নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য স্কুল খোলা। নতুন শিক্ষাবর্ষে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য স্কুল খোলার বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছিল। শুরু হয়ে গিয়েছিল মানসিক প্রস্তুতিও। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে যারা স্কুলবাসে যেতে চায়, তাদের নাম নথিভুক্ত করার কাজও শুরু করে দিয়েছিল বেসরকারি কিছু স্কুল। কিন্তু সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় এবং মুখ্যমন্ত্রীর এ দিনের ঘোষণায় আবার জমছে আশঙ্কার মেঘ। নবম থেকে দ্বাদশের অফলাইন ক্লাস বন্ধ হয়ে গেলে প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসের কী হবে? বেথুন কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা শাশ্বতী অধিকারীর বক্তব্য, পড়াশোনার ক্ষতি হবে মারাত্মক।
উত্তর ২৪ পরগনার দক্ষিণ চাতরা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণাংশু মিশ্রের মতে, ফের স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে কি না, সেই প্রশ্নও উঠবে। তিনি বলেন, “ফের স্কুল বন্ধ হলে সব থেকে খারাপ অবস্থা হবে গ্রামের স্কুলগুলির। আমাদের স্কুলে এখন ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে। পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হতে আসা অনেক ছেলে দেখলাম, একটা সরল বাক্য পর্যন্ত গঠন করতে পারছে না। অফলাইন ক্লাস শুরু হয়ে গেলে এরা উপকৃত হত।”
রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (ওয়েবকুটা) সভাপতি শুভোদয় দাশগুপ্তের অভিযোগ, ‘‘মেলা, খেলা, উৎসবে সব আনলক রেখে অন্যান্য সময়ে অন্যান্য প্রয়োজনে ফের লকডাউনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হচ্ছে। স্কুল-কলেজ হয়ে যাচ্ছে ‘কমন টার্গেট’ বা সাধারণ নিশানা। পরিণামে পড়ুয়াদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা হবে ভয়াবহ।’’
এ দিকে, ১ থেকে ৭ জানুয়ারি ‘ছাত্র দিবস’ পালন করার কথা বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সেই নির্দেশ মেনে এ দিন বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে শিক্ষা দফতর। তাতে জানানো হয়েছে, ৩ জানুয়ারি নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পালিত হবে ছাত্র সপ্তাহ। স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড এবং অন্যান্য প্রকল্পের কী কী সুবিধা, সেই বিষয়ে অবহিত করা হবে পড়ুয়াদের। সে-দিন পাঠ্যপুস্তকও বিলি করার কথা। এই ছাত্র দিবসে অভিভাবকের হাতে তুলে দেওয়া হবে মিড-ডে মিলের সামগ্রী এবং পাঠ্যপুস্তক। ঠিক হয়েছে, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড সম্পর্কে পড়ুয়াদের জানানোর জন্য স্কুল-কলেজে শিবির বসবে। পড়ুয়ারা নানান স্কলারশিপের বিষয়েও জানতে পারবে। করোনা সংক্রমণ বাড়ায় যখন ফের স্কুল বন্ধ করার কথা উঠছে, সেখানে ঘটা করে ছাত্র দিবস পালন করা হবে কী ভাবে, প্রশ্ন শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একাংশের।
শিক্ষা শিবির জানাচ্ছে, করোনাকালে অনলাইন পঠনপাঠন চললেও ক্ষতি হয়েছে প্রান্তিক এলাকার পড়ুয়াদের। স্মার্টফোন, ঠিকঠাক নেটওয়ার্কের অভাবে তারা শুধু পিছিয়েই পড়েনি, তাদের অনেকে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে রোজগারে নেমে পড়তে বাধ্য হয়েছে। এই সময়ে জোর করে বিয়েও দিয়ে দেওয়া হয়েছে বহু ছাত্রীর। অফলাইনে নবম থেকে দ্বাদশের ক্লাস আবার শুরু হওয়ার পরে তাদের অনেককেই আবার স্কুলমুখী করার চেষ্টা চলছে। প্রশ্ন উঠছে, ফের স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে সেই প্রচেষ্টার কী হবে?
যোধপুর পার্ক বয়েজ স্কুলের প্রধান শিক্ষক অমিত সেন মজুমদার বলেন, “ভেবেছিলাম, এ বার অন্তত পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির ক্লাস অফলাইনে চালু হয়ে যাবে। সব পরিকল্পনা বিশ বাঁও জলে চলে গেল।”
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির (জুটা) সাধারণ সম্পাদক পার্থপ্রতিম রায় তির্যক সুরে
বলেন, ‘‘সরকার পার্ক স্ট্রিটে ক্রিসমাস উদ্যাপন, অন্যান্য উৎসব বা রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল করতে দিতে পারে। সেখানে করোনার ভয় নেই। যত ভয় শুধু পড়াশোনার ক্ষেত্রে!”
সারা বাংলা সেভ এডুকেশন কমিটির সম্পাদক তরুণ নস্করের বক্তব্য, করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির ‘অজুহাতে’ আবার স্কুল-কলেজ বন্ধ করার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। আইসিএমআরের পরিষ্কার বক্তব্য, ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের করোনা সংক্রমণের ভয় সব থেকে কম। তাই তাদের জন্য স্কুল খোলা উচিত।
টিকার ব্যবস্থা করে স্কুল-কলেজ আবার বন্ধ করলে পড়াশোনার ভীষণ ক্ষতি হবে।
অ্যাডভান্স সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেসসের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক চন্দন মাইতি বলেন, ‘‘প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্যও স্কুল খুলে দেওয়া দরকার বলে সম্প্রতি আমাদের সংগঠনের বার্ষিক সাধারণ সভায় সহস্রাধিক প্রধান শিক্ষক একমত হয়েছিলেন। পুনরায় স্কুল বন্ধ হলে ক্ষতি হবে শিক্ষারই।’’