‘পড়শি’ এই ধারণা বা শব্দটার মানে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি বুড়ো বয়েস পর্যন্ত। কখনও শব্দটা বড্ড রূঢ় মনে হয়েছে, কখনও বা বড় কাছের।
সত্যি বলতে কী গাঁয়ে থাকার সময় ‘পড়শি’ কাকে বলে বুঝতেই পারিনি। বোলপুর থেকে মাইল দশেক দূরে ‘বড়া’ নামে এক গাঁয়ে আমার জন্ম ও প্রাথমিক পড়াশোনা। পুরো গাঁ’টা পাড়া দিয়ে ভাগ করা থাকত। মিত্তির পাড়া, ঠাকুর পাড়া, বাগদি পাড়া, ডোম পাড়ার বন্ধুরা, শিশিরদের কামারশালা, হরিদের পুরুত কাকা, কাশীদের বলদজোড়া সবাইকেই বড্ড আপনজন মনে হতো। কাঁচা ডিম নুন মাখিয়ে সবাই মিলে খাওয়া বা রাতের বেলায় শ্মশানে গিয়ে শকুনের ঘোরাফেরা দেখা— এই সব মিলিয়েই আমার গাঁ। তখন মনে হতো, গোটা গাঁ’য়ের ছোট-বড় সব জিনিসই আমার পড়শি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে।
এরপর মফস্সল শহর বোলপুরে পড়তে আসা। তখন থেকেই মনের মধ্যে ‘পড়শি’ ‘পড়শি’ ধারণাটার জন্ম হতে শুরু করে। বাদল, প্রদীপ-সহ একঝাঁক তরুণ এসেছিল ওপার বাংলা থেকে। বাদলের মা’য়ের বাঁধাকপি রান্না বা বাবলুদের পাঁউরুটির কারখানায় ঢুঁ মারতে গিয়ে বারবার মনে হতো ওরা আমার কে হয়? রাতের বেলায় শুয়ে মন খারাপ হতো ওদের জন্য। আপনজনের জন্য এই মনখারাপটাকেই কি পড়শি বলে? কে জানে!
পড়শি মানেটা খুব কঠিনভাবে আমার কাছে ধরা দিল দিন কয়েকের মধ্যেই। আমাদের বাড়ির সামনে থাকতেন গোলাপীকুটিরের এক্সাইজ ইন্সপেক্টর আর তাঁর নতুন বউ। আমি ওঁদের কাকু, কাকিমণি বলতাম। রাত হলেই প্রতিদিন কাকু খারাপ খারাপ কথা বলে মারধর করতো কাকিমণিকে। রাতে আমার একলা ঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে কাকিমণির চোখে জল দেখতে পেতাম। বারবার মনে হতো ওঁরা দু’জন এক ঘরে থেকেও যেন দূরে রয়েছেন— পড়শির মতোই। এখানে পড়শি ধারণাটার সঙ্গে যেন একটা ‘দূরের কেউ’ ভাবনার যোগ রয়েছে।
‘পড়শি’ শব্দটাকে ঘিরে আমার মাঝেসাঝেই বেশ অভিমানও হতো। যৌথ পরিবারে বড় হয়েছি। কিন্তু ডাক্তারবাবুর কাছে গিয়ে বা কাপড়ের দোকানে জিনিস কিনতে গিয়ে অভিভাবকের নাম হিসেবে দাদার নাম লিখতে হতো। এটা বড় কষ্ট দিয়েছিল, ওই ‘নাম’ অভিভাবকত্বকে আমার ‘পড়শি’ বলে মনে হয় তখন।
তবে ‘পড়শি’ শব্দটার অন্য অন্য এক মানেও বুঝলাম আরও বছর খানেক পর। স্নাতকোত্তর পড়ার সময় এলাম বর্ধমানে। ডেরা বাঁধলাম হস্টেলে। আমাদের হস্টেলের আশেপাশে তখন কোনও বাড়িঘর তেমন ছিল না। হস্টেলের খুব কাছেই ছিল একটা মর্গ। একদিন সন্ধ্যেবেলা মর্গের পাশ দিয়ে চার বন্ধু গুলতানি মারতে মারতে ফিরছি। দেখি এক বছর ২৫-এর যুবক আমাদের ইশারা করে ডাকছেন। শুনলাম, তিনি তাঁর স্ত্রী’কে খুন করেছেন। শেষমেশ আদালতের অনুমতি নিয়েই স্ত্রী’র দেহ সৎকার করতে এসেছেন। কিন্তু সৎকারের জন্য কেউ পাশে নেই। আমরা সবাই মিলে ওই মহিলার দেহ সৎকার কররলাম। ওই মুহূর্তে ভীষণ করে মনে হয়েছিল ওই যুবকটি আমাদের খুব কাছের জন। পড়শি। আর ওই মহিলা আমাদের বাড়ির মা-কাকিমা’র মতো।
অধ্যাপনা, বই লেখা, সম্পাদনার কাজ শুরু হল পড়াশোনার প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ চুকিয়ে। কালক্রমে প্রকাশকের বাড়ি, লাইব্রেরি আর বাড়ির চারদিকে সিলিং পর্যন্ত ডাঁই করে রাখা ‘কালো অক্ষরের’ বই-ই হয়ে যেতে থাকল শ্রেষ্ঠ পড়শি। যে পড়শির মধ্যে মনের খোরাক খুঁজে পাওয়া যায়। এমনকী বইয়ের দু’টো ছাপার লাইনের মধ্যেও যেন একটা ভাষা আছে।
বুড়ো বয়সে উঠে এলাম হাওড়ার ফ্ল্যাটে। শুনেছিলাম ফ্ল্যাট কালচার বলে একপ্রকার বিশেষ যাপনের ধারণা প্রচলিত। শুনেছিলাম এই যাপনে দাঁত বার করে হাসা বারণ বা জোরে কথা বলাও। নিষেধ রয়েছে আড্ডা মারাতেও। পাশের ঘরের দরজা খোলা থাকলেও পাশের বাড়ির লোকটিকে পড়শি ভাবা মানা। এই লেখাটা লিখতেই লিখতেই আচমকা দরজায় টোকা। ভুল হল কলিং বেল। ব্যাস আমার লেখা শেষ। কারণ আমাদের অ্যাপার্টমেন্টের লায়ন, পিকু, টিঙ্কু, ভোম্বলরা এসে গেছে। একঝাঁক কচিকাঁচার দল। ওদের সঙ্গেই এখন সারাবেলা ‘সবুজের অভিযান’ চলবে। ওরাই এখন আমার পড়শি বা বলা ভাল আপনজন।
ছবি: অনির্বাণ সেন।