অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস
কম্পিউটার হঠাৎ বসে গেলে স্বয়ং-মেরামতির অনেক কৌশলের মধ্যে একটা হল: রেস্টোর-পয়েন্ট। তার মানে, শেষ কবে আপনার কম্পিউটার কর্মিষ্ঠ ছিল সেই তারিখের দশায় তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আবার স্ব-চল করা।
আমাদের স্বাধীনতার ধারণাটা ঠিক ওইরকম। শেষ কবে আমরা স্বাধীন ছিলাম, সেই দিনটা ঠিক করে ফেলুন, তারপর মিলিয়ে নিন, সেই নিরিখে আজ আপনি স্বাধীন কিনা। সমস্যাটা এখানেই। মুসলমানরা মনে করেন, আমরা পরাধীন হয়েছি ১৭৫৭ সালে। হিন্দুরা বলবেন, আমরা পরাধীন হয়েছি তার ঢের আগে— পাঠান-মোগলদের হাতে (কিন্তু আশ্চর্য, শক-হুন-দলের হাতে নয়)। ‘স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে’ লিখে রঙ্গলাল একই নিঃশ্বাসে ব্রিটিশের জয়গান গেয়েছিলেন। অর্থাৎ, তাঁর কাছে ব্রিটিশের অধীনতাটা পরাধীনতা নয়, বরং মুসলিম অপশাসনের হাত থেকে মুক্তি। স্বাধীনতা মানে কি তাহলে কেবল সংখ্যাগুরুর ধর্মাচরণেরই স্বাধীনতা? বাকিটুকু থাকল-গেল, তাতে কিছু এসে যায় না?
স্বাধীনতার এই সনাতন হিন্দুমুখী চিত্রকল্পটি চমৎকার ফুটে উঠেছিল গাঁধী-হত্যার তিন বছর পর ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৫১, জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠার দিন। মঞ্চে শুভ্র পটে আঁকা কয়েকটি ছবি: কুরুক্ষেত্রে ক্লৈব্য-আক্রান্ত অর্জুনকে ভোকাল টনিক দিচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ, অন্যদিকে শিবাজি আর রানা প্রতাপ এবং একটি গেরুয়া প্রদীপ। মঞ্চে আসীন জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর পার্টি পাকিস্তান দখল করে নিয়ে মাতৃভূমির ঐক্য ফেরাতে চাইল, মুসলমানদের নিন্দা করল এই বলে যে তারা এই দেশের মাটি আর সংস্কৃতিকে আপন করে নিতে শেখেনি। সেদিন অবশ্য ভোটাররা বিশেষ পাত্তা দেয়নি কথাটাকে।কিন্তু আজ দিচ্ছে, প্রবলভাবে দিচ্ছে।
সহজ যুক্তিটা হল, মাথাগুনতিতে সারা ভারতে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই শাসনের রাশ তাদেরই হাতে থাকবে। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের জন্মভূমির সবই যে আর্যাবর্তের চেয়ে আলাদা: অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। কাজেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি অনুযায়ী অবিভক্ত বাংলার শাসনভার থাকবে মুসলমানদের সমর্থিত দলের হাতে, এটাই গণতন্ত্র ও যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু বাঙালি হিন্দুরা সে-যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁদের মতে, মুসলমানরা সংখ্যায় যত বেশিই হোক, ওরা আসলে বিদেশি, কারণ ওদের ধর্মটা বিদেশ থেকে আমদানি। সাভারকরের মূল তত্ত্ব তো এইটাই: তারাই সাচ্চা ভারতীয়, যাদের পুণ্যভূমি ভারতে,মক্কায় কিংবা জেরুজালেমে নয়। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়, ধর্মীয় পরিচয়ের যুক্তিটাই বাংলায় প্রযোজ্য। এইখানে তাহলে স্বাধীনতার যুক্তির গোড়ায় একটা গলদ রয়ে গেল: স্বাধীনতাটা দেশের নয়, হিন্দুদের,অন্যরা তার ফলভোগী।
আজকের আমজনতার স্বাধীনতাহীনতার বীজ স্বাধীনতার ওই দ্বৈত-ধারণাটির মধ্যেই উপ্ত ছিল। ভেবে দেখুন, সাভারকরের হিন্দুত্ববাদের তত্ত্ব আর্যাবর্তে নিমেষে গৃহীত হয়ে গেল। কংগ্রেসের মধ্যে চোরাগোপ্তা এবং প্রকাশ্য হিন্দুত্ববাদীর সংখ্যা কিছু কম ছিল না। ‘বন্দে মাতরম’ গান নিয়ে বিতর্কর সময় সেটা স্পষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বাংলায়,হয়তো চিত্তরঞ্জন দাশের প্রভাবে, হিন্দুত্ববাদ অতটা প্রবল হতে পারেনি। সেটা হল একটু পরে, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। বাংলায় আর্যাবর্তীয় হিন্দুত্ববাদের ভগীরথ তিনিই। শিক্ষাদীক্ষার জেল্লা এবং বংশপরিচয়ের জোরে তিনি পশ্চিমবঙ্গীয় বর্ণহিন্দুদের কাছে সহজেই গ্রহণীয় হয়ে ওঠেন। ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে সাভারকর এলেন কলকাতায়। শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে আলোচনা হল তাঁর। তারই পরিণতিতে ওই বছর অগস্টে শ্যামাপ্রসাদের হিন্দু মহাসভায় যোগদান। নভেম্বর মাসে কলকাতার দেশবন্ধু পার্কে (ইতিহাসের পরিহাস!) বহু লোকের উপস্থিতিতে সভা কাঁপিয়ে তোলেন তিনি। বাংলায় এক নূতন যুগের অন্ধকার নেমে এল। তাকে বলতে পারি হিন্দু স্বাধীনতার নামে অন্যদের স্বাধীনতাহীনতার আরাধনা।
ইতিমধ্যে সুভাষ বসু তাঁর ফরওয়ার্ড ব্লক নিয়ে অবতীর্ণ। গুরু দেশবন্ধুর কাছে ধর্ম-নিরপেক্ষ রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন তিনি। হিন্দু মহাসভাকে সাম্প্রদায়িক দল মনে করতেন। নবনেতা শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে লেগে গেল তাঁর। সুভাষ সোজাসুজি শ্যামাপ্রসাদকে লিখলেন, দরকার হলে বলপ্রয়োগ করে বাংলায় আপনাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে দেব। তা অবশ্য পারেননি। কারণ ‘বলপ্রয়োগের’ ক্ষমতা শ্যামাপ্রসাদের দলেরও কিছু কম ছিল না, হয়তো বেশিই ছিল। মুসলমান-বিরোধিতার নামে নানা ধরনের ‘বলশালী’ হিন্দুকে দলে টেনে আনার সুযোগ ছিল তাঁর। অচিরেই তার প্রমাণ মিলল। ‘বলশালী কিছু সন্ন্যাসী’ পাঠিয়ে সুভাষের কর্মীদের ঢিট করবার ব্যবস্থা নিলেন ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী প্রণবানন্দ। কে জানে, যোগী আদিত্য তাঁর ছাত্র কিনা।
আরও পড়ুন: অমিত শাহের করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ, এ বার জানালেন নিজেই
সর্বনাশের বীজ রোপিত হয়ে গেল। ধর্মসাধক দরিদ্রসেবক হিন্দু সন্ন্যাসীরা ধর্মাচরণ ছেড়ে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ পেটানোর কাজ করতে পথে নামলেন। এর পর কলকাতা পৌরসভার নির্বাচনে দেখা গেল, ফরওয়ার্ড ব্লক আর হিন্দু মহাসভার ফল সমান সমান। শ্যামাপ্রসাদ সুভাষকে বললেন, আসুন, আমরা হাত মিলিয়ে মুসলিম লিগকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখি। সুভাষ নারাজ। হার মানলেন শ্যামাপ্রসাদ। তবে নিজের দলে তাঁর প্রতাপ বাড়ল। হিন্দু মহাসভার মধ্যে শ্যামাপ্রসাদই হয়ে উঠলেন সাভারকারের পর অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৪৪ সালে বললেন, ভারতের স্বাধীনতা হিন্দুরাই আনবে। কিন্তু তারা মহান ও উদার, তাই অন্য সম্প্রদায়কেও সেই স্বাধীনতার ভাগ দেবে। প্রতিদ্বন্দ্বী সুভাষ ততদিনে দেশছাড়া।
পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু উচ্চবর্ণ শ্যামাপ্রসাদকে পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা বলেন।
আরও পড়ুন: স্থিতিশীল প্রণব মুখোপাধ্যায়, সাড়া দিচ্ছেন চিকিৎসায়, জানালেন ছেলে অভিজিৎ
তার মানে, শ্যামাপ্রসাদের স্বাধীনতার ‘রেস্টোর পয়েন্ট’-টা বরাবরই, জনসঙ্ঘ স্থাপনার আগেও, ছিল তথাকথিত হিন্দু ভারত, কিংবা বলা ভাল, প্রাক্-মুসলমান ভারত। গোলওয়ালকরকে বলেছিলেনশ্যামাপ্রসাদ, ‘‘হিন্দুরাষ্ট্রকে তার অতীত গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিপূরক, বিরোধী নয়।’’ শ্যামাপ্রসাদ প্রথম দিকে আদৌ দেশভাগ চাননি, কারণ অ-হিন্দু মুসলমানদের হাতে দেশের এতখানি জায়গা চলে যাবে, এ তাঁর কাছে অসহ্য। কিন্তু যখন দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠল, তখন বঙ্গদেশকে অবিভক্ত রাখার বদলে ভাঙবার জন্য তিনি উঠেপড়ে লাগলেন। একটা সময় অখণ্ড বঙ্গরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব উঠেছিল। তিনি তার ঘোর বিরোধিতা করেন এই যুক্তিতে যে তাহলে তো মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে আর মুসলিম লিগ ওই রাষ্ট্রের সংবিধান রচনা করবে। পশ্চিমবঙ্গীয় হিন্দু উচ্চবর্ণ এই কারণেই তাঁকে পশ্চিমবঙ্গের স্রষ্টা বলেন। আবারও, সংখ্যাগরিষ্ঠতা নয়, ধর্মীয় পরিচয়ই হয়ে উঠল মাপকাঠি।
সাভারকর-গোলওয়ালকর-শ্যামাপ্রসাদের রোপণ করে যাওয়া বিষবৃক্ষের বীজ থেকে আজ স্বাধীন ভারতের ফুটিফাটা দেওয়ালে যত্রতত্র গাছ গজাচ্ছে, দেওয়াল ভাঙল বলে। চার ঘণ্টার নোটিসে লকডাউন নামিয়ে আনা, পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে কুকুর-বেড়ালের মতো ব্যবহার করা, এই করোনা-আক্রান্ত পরিমণ্ডলেও রামজন্মভূমির অ্যাজেন্ডা ফিরিয়ে আনা, নয়া শিক্ষানীতি ধাঁ করে পাশ করিয়ে নেওয়া, পনেরোই অগস্টের মধ্যেই করোনা ভ্যাকসিন বানিয়ে ফেলার ঘোষণা, আর করোনার জন্য মুসলমানদেরই দায়ী করা, সবকিছুর মধ্যেই ফুটে উঠছে হিন্দুত্ববাদী সর্বগ্রাসিতা: হিন্দ্, হিন্দি, হিন্দুর রোয়াবি। একটা নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে: হিন্দু বলতে এখন বোঝানো হয় মূলত শত-কোটিপতিদের ও তাদের চামচাদের। বাকিরা খরচের খাতায়—হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে।
১৫ অগস্টের মধ্যেই করোনা ভ্যাকসিন বানিয়ে ফেলার ঘোষণা, আর করোনার জন্য মুসলমানদেরই দায়ী করা, সবকিছুর মধ্যেই ফুটে উঠছে হিন্দুত্ববাদী সর্বগ্রাসিতা।
হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রিস্টান পরিচয়ে নয়, ভারতবাসীকে যারা চিনত কেবল ভারতের উৎপাদনশীল অধিবাসী বলেই, তারা আজ অণুবীক্ষণ দূরবীক্ষণ দুটোরই পাল্লার বাইরে। ভারতের খণ্ড-স্বাধীনতার বীজ থেকে যে-ফল ফলার কথা, সেই ফলই ফলেছে। কারও কারও রুচিতে সে-ফল মাকালেরই মতো সুন্দর।
শেষ করব ‘সমার্থশব্দকোষ’ থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দ-সংলগ্ন কতকগুলি প্রতিশব্দ দিয়ে—আপনার করোনা-অবসর কাটানোর খোরাক হিসেবে:অধিকার, দাবি, হক। নিরপেক্ষতা, অনপেক্ষতা। বন্ধনহীনতা। মুক্তি। স্বাবলম্বন।
স্বাধীনতার ‘রেস্টোর পয়েন্ট’ খোঁজার কাজে এগুলো সহায়ক হতেও পারে।