শোভন চট্টোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাটে সাংবাদিক সম্মেলনে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।
সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে তোপ দেগে চাকরিতে ইস্তফা দেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন মিল্লি আল আমিন কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে বসে শোভন চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন তুললেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ভূমিকা নিয়ে। যে পার্থ কিছু দিন আগে তাঁর বাড়িতে বসেই আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন, বৈশাখীকে কোনও সমস্যায় পড়তে দেবেন না, সেই পার্থ এখন কী করছেন? প্রশ্ন কলকাতার প্রাক্তন মেয়রের। আর এই যৌথ তোপের ধাক্কা সামলাতে পাল্টা সাংবাদিক বৈঠক ডেকে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘আমি ব্যথাই পেলাম।’’
বৈশাখী এ দিন বিস্ফোরক অভিযোগ এনেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব তথা সরকারের বিরুদ্ধে। কর্মক্ষেত্রে এ বার তাঁকে চরম হেনস্থার মুখে ফেলার ষড়যন্ত্র হয়েছে বলে তাঁর দাবি। শোভন চট্টোপাধ্যায়কে তৃণমূল বাগে আনতে পারছে না বলেই এই ভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার চেষ্টা করছে, এমন ইঙ্গিতও এ দিন বেশ স্পষ্ট করেই দিতে চেয়েছেন বৈশাখী। গোলপার্কে শোভনের ফ্ল্যাটেই সাংবাদিক সম্মেলনটি করেন বৈশাখী। সারা ক্ষণ পাশে বসে থেকে শোভন চট্টোপাধ্যায়ও বুঝিয়ে দেন, বৈশাখীর বক্তব্যকে তিনি সমর্থনই করছেন।
যে কলেজের তিনি ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষা, সেই মিল্লি আল আমিনেরই এক শিক্ষিকা শাবিনা নিশাত ওমরকে কাজে লাগিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু হয়েছে বলে বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন দাবি করেন। গত কয়েক দিনে শাবিনা নিশাত ওমর একাধিক বার কলেজে দাঁড়িয়ে ফেসবুক লাইভ করেছেন। তাতে বৈশাখীর বিরুদ্ধে শাবিনাকে একগুচ্ছ অভিযোগ করতে দেখা গিয়েছে। ফেসবুক লাইভগুলিতে শাবিনার দাবি, তাঁকে বৈশাখী হাজিরা খাতায় সই করতে দিচ্ছেন না, তাঁর ক্লাস নেওয়ার রুটিন রোজ বদলে দিয়ে হেনস্থা করছেন। সাম্প্রদায়িক কারণেই তাঁকে কোণঠাসা করা হচ্ছে বলেও শাবিনা অভিযোগ করেন ফেসবুক লাইভে।
আরও পড়ুন: জমির খাজনার প্রমাণ দিন, অযোধ্যা মামলায় নির্মোহী আখড়াকে বলল সুপ্রিম কো
শাবিনার এ হেন অভিযোগকে ‘সাম্প্রদায়িক উস্কানি’ হিসেবেই দেখছেন বৈশাখী। তাঁর কলেজ সংখ্যালঘু প্রধান এলাকায় এবং সেখানেই তাঁর বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ক্ষেপিয়ে তুলে তাঁর চরম ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন শাবিনা— দাবি বৈশাখীর। শাবিনার ফেসবুক লাইভের বিষয়ে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং উচ্চশিক্ষা দফতরের বেশ কয়েক জন পদস্থ কর্তা সব জানেন বলেও বৈশাখী মন্তব্য করেন। পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ইচ্ছাতেই এ সব হচ্ছে বলেও তাঁর দাবি। তাঁর সংযোজন— মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছাতেই পার্থ চট্টোপাধ্যায় এই পথ নিয়েছেন বলে তিনি শুনেছেন।
শোভনের যে ফ্ল্যাটে এ দিন সাংবাদিক সম্মেলনটি হয়েছে, গত ২৩ জুলাই রাতে সেখানেই গিয়েছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। শোভন ও বৈশাখীর সঙ্গে সে দিন পার্থর দীর্ঘ কথোপকথন হয়। শোভন যাতে ফের তৃণমূলের হয়ে সক্রিয় হন, তার চেষ্টা করতেই যে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ওই মধ্যরাতের বৈঠক, তা এখন কারও অজানা নয়। পার্থ এ দিন নিজেও তা স্বীকার করেন। কিন্তু সে দিনের বৈঠকের প্রসঙ্গ টেনে শোভন এ দিন পার্থকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছেন। শোভন জানান, বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে এর আগেও প্রশ্ন তোলার চেষ্টা হয়েছিল, তখন তিনি নিজে পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন যে, প্রয়োজনে বৈশাখী পদত্যাগ করবেন। কিন্তু পার্থ বারণ করেন। বৈশাখীর যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি পার্থবাবু বার বার দিয়েছিলেন বলে শোভন জানান। গত ২৩ জুলাই শোভনের ফ্ল্যাটে হওয়া বৈঠকেও পার্থবাবু সেই রকম আশ্বাস জোরের সঙ্গে দিয়েছিলেন বলে শোভন দাবি করেন। সে সব আশ্বাসের পরে এখন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলেজে যা চলছে এবং শিক্ষা দফতর তা নিয়ে যে রকম ‘নিষ্ক্রিয়’, তা কি পাশে থাকার নমুনা? প্রশ্ন বেহালা পূর্বের বিধায়কের।
সাংবাদিক সম্মেলনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়।—নিজস্ব চিত্র।
শাবিনা নিশাত ওমর তাঁর সম্পর্কে কী বলেছেন, সাংবাদিক সম্মেলনে তা দেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন বৈশাখী। তার পরে শাবিনার তোলা অভিযোগগুলোর জবাব দিতে শুরু করেন তিনি। ‘সাম্প্রদায়িকতা’র যে অভিযোগ শাবিনা তুলেছেন, তার জবাব দিতে গিয়ে বৈশাখী ভেঙে পড়েন। সরাসরি মুখ্যমন্ত্রীকে সম্বোধন করে তিনি বলেন, ‘‘আমাকে আপনি অনেক অপমান করেছেন, আমার সম্মান অনেক রকম ভাবে নষ্ট করেছেন। দয়া করে আমার সত্তাকে নষ্ট করে দেবেন না।’’ বাষ্পাকুল চোখে বৈশাখীর মন্তব্য, ‘‘আমাকে সাম্প্রদায়িক বলবেন না। আমার শিক্ষা আমাকে সাম্প্রদায়িক হওয়ার অনুমতি দেয় না।’’
আরও পড়ুন: শ্রীনগরে পুলিশের তাড়া খেয়ে বিক্ষোভকারীর মৃত্যু, স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললেন ডোভাল
বৈশাখী এ দিন জানান যে, তিনি উচ্চশিক্ষা দফতর থেকে বেশ কয়েকটি ফোন পেয়েছেন, কলেজেও অনেক কথা শুনছেন। তিনি বলেন, ‘‘শুনছি আমাকে টিচার ইনচার্জ পদ থেকে সরানো হবে, শুনছি মুখ্যমন্ত্রীই নাকি সেটা চাইছেন।’’ পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের উদ্দেশে তাঁর মন্তব্য, ‘‘যদি মনে করেন আমার ভুল হয়েছে, বকুন। কিন্তু পিছন থেকে ছুরি মারবেন না।’’ এ কথা বলার পরেই ইস্তফার কথা ঘোষণা করেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘এই অসম লড়াই আমি আর লড়তে পারছি না। আমি হেরে গিয়েছি। আমি আজ শুধু টিচার ইনচার্জ পদ থেকে নয়, চাকরি থেকেই ইস্তফা দিচ্ছি।’’ বৃহস্পতিবার রাজ্যপালের কাছে গিয়ে তিনি নিজের পদত্যাগপত্র জমা দিয়ে আসবেন বলে বৈশাখী জানান।
বৈশাখীর সাংবাদিক সম্মেলনে এ দিন হাজির ছিলেন মিল্লি আল আমিন কলেজের প্রায় সব শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মী। ইস্তফার ঘোষণা শুনেই তাঁর তীব্র প্রতিবাদ করেন। মাইক হাতে তুলে নিয়ে তাঁরা জানান যে, তাঁরা সকলেই বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে রয়েছেন। যে শিক্ষিকা ফেসবুক লাইভে বৈশাখীর বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে পাল্টা একগুচ্ছ অভিযোগ তোলেন অন্য শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরা।
সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত শোভন চট্টোপাধ্যায়কেও তাঁরা অনুরোধ করেন বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিরস্ত করার জন্য সক্রিয় হতে। কিন্তু শোভন তেমন কোনও প্রতিশ্রুতি দেননি। কলেজের প্রায় সকলেই যে সাংবাদিক সম্মেলনে হাজির হয়ে বৈশাখীর পাশে দাঁড়িয়েছেন, তা নিয়ে ‘কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশ করেন শোভন। তার পরে বৈশাখীর উদ্দেশে বলেন যে, ‘‘এই লড়াইকে অসম লড়াই মনে করার কোনও কারণ নেই। লড়াইটা যুক্তির।’’ তবে তার পরেই শোভন জানান, কোনও সিদ্ধান্তই তিনি বৈশাখীর উপরে চাপিয়ে দেবেন না। তিনি বলেন, ‘‘বিপদের বন্ধুর পাশে আমি আগেও ছিলাম, এখনও রয়েছি। বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাকেই সমর্থন করব। তার জন্য যা করতে হয় করব।’’
বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে একাধিক বার প্রকাশ্যেই বিরক্তি বা উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল চেয়ারপার্সন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিক্ততা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, মন্ত্রিত্ব ও মেয়র পদে ইস্তফা দিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যান শোভন। তার পরেও দলের তরফে তাঁকে সক্রিয় করে তোলার অনেক চেষ্টাই হয়েছে। কিন্তু সে সব চেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায় এ বার যে ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অভিযোগ আনছেন, তার পরে কি আর তৃণমূলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কথা তিনি ভাবছেন? তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে শোভন বলেন, ‘‘তৃণমূলের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রয়েছে কি না, তা আমিও জানি, আপনারাও জানেন। ভবিষ্যতে কী করব, সময় এলেই দেখতে পাবেন।’’
শোভন-বৈশাখীর এই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মিডিয়ার মুখোমুখি হন পার্থ। ২৩ জুলাইয়ের বৈঠকের সঙ্গে বৈশাখীর কলেজের ঘটনার কোনও সম্পর্ক নেই বলে পার্থ দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘‘রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে, দাদা হিসেবে আমি শোভনের বাড়ি গিয়েছিলাম। তিনি নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছেন, সক্রিয় করে তুলতে গিয়েছিলাম। কিন্তু বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পেশাগত দিকটার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। এই দুটোকে এক করে দেখার কোনও মানে হয় না।’’
তৃণমূলের হয়ে শোভন সক্রিয় হচ্ছেন না বলে তিনি বৈশাখীকে কর্মস্থলে হেনস্থা করার ব্যবস্থা করছেন— এই অভিযোগে তিনি ব্যাথা পেলেন বলে পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান। বৈশাখীর প্রতি পার্থর বার্তা, ‘‘আমি বলব মাথা ঠান্ডা করুন। সসম্মানে কাজ করুন।’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এ দিন তোলা হয়েছে, সে প্রসঙ্গে পার্থ বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এত সময় নেই যে এক জন শিক্ষয়িত্রীর পিছনে নজরদারি করবেন। এটা তাঁকেও ছোট করা হয়।’’
বৈশাখী বন্দ্যোপাধ্যায়কে হেনস্থা করার চেষ্টা হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষামন্ত্রী কোনও পদক্ষেপ কেন করছেন না? শোভন এবং বৈশাখী দু’জনেই এ প্রশ্ন এ দিন তোলেন। পার্থ তার জবাবে বলেন, ‘‘উনি তো অনেক জায়গায় অভিযোগ করেছেন শুনছি। আমাকেও একটা প্রতিলিপি দিন। যদি অভিযোগ সত্য হয়, দেখুন আমি ব্যবস্থা নিই কি না।’’ সাংবাদিক সম্মেলন করে এ সব অভিযোগ করার আগে তাঁকে এক বার ফোন করে অভিযোগগুলো জানানো হল না কেন? সে প্রশ্নও পার্থ তোলেন। তা হলে কি বৈশাখীকে চাকরি ছাড়তে বারণ করবেন তিনি? পার্থ বলেন, ‘‘কেউ যদি চাকরি ছেড়ে বড় কিছু করতে চান, তা হলে কি আমি তাঁকে বলব যে, করবেন না! আমি শুধু বলব, আবেগের বশে, উত্তেজনার বশে কোনও সিদ্ধান্ত নেবেন না।’’