মনের আনন্দেই পুজো করেন সৌগত।
হাওড়া-বর্ধমান মেন লাইনে হুগলি জেলার বৈদ্যবাটি স্টেশন। তার পরে হাঁটাপথ। মিনিট দশেক। চক গোয়ালাপাড়া। চতুর্বর্ণ মানলে এ পাড়ায় মূল বাস শূদ্রদের। হিন্দু বর্ণপ্রথায় যার স্থান একেবারে নীচে। চক গোয়ালাপাড়ার এক গোয়ালা পরিবারের ছেলে সৌগত ঢোলে। বাবা দেবকুমার ঢোলের সঙ্গে পারিবারিক দুধ, পনিরের ব্যবসায় টুকটাক হাত লাগালেও রিষড়া বিধানচন্দ্র কলেজের পড়ুয়া সৌগত।
এ সব অবশ্য আসল পরিচয় নয় সৌগতর। বরং, পাড়ায় সবাই তাঁকে ঢোলে ঠাকুর নামেই বেশি চেনে। তার কারণও আছে। বছর পাঁচেক ধরে দুর্গাপুজো শুরু করেছেন তিনি। না, কোনও বারোয়ারি পুজো নয়। বরং নিজের বাড়ির পুজোকেই সর্বজনীন করে তুলেছেন সৌগত। শুধু মন্ত্রোচ্চারণ বা অর্ঘ্য নিবেদন নয়, তাঁর দেবী সাধনা শুরু হয়ে যায় অনেকে আগে থেকেই। আসলে ঢোলে বাড়ির পুজোর গোড়া থেকেই, পটুয়া কিংবা পুরোহিত, সবটাই দেবকুমার গোয়ালার একমাত্র ছেলে শুভ। বাড়ি কিংবা পাড়ার সবাই ওই নামেই ডাকে সৌগতকে।
শুভর মুখেই শোনা গেল তাঁর দুর্গাসাধক হয়ে ওঠার কাহিনি। বাবারা তিন ভাই। যৌথ পরিবার ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসাও ছোট হয়েছে। তবে হাঁড়ি আলাদা হলেও এখনও এক বাড়িতেই সবার বাস। কাছেই বিয়ে হয়েছে দুই পিসির। সব মিলিয়ে যৌথ পরিবারের অনুভবটা রয়ে গিয়েছে। আর দুর্গাপুজো এলে সবাই এক হয়ে যায়। নতুন এক বনেদিয়ানা যেন তৈরি হচ্ছে শুভর হাত ধরে।
শুভকে অবশ্য কেউ সে ভাবে হাতে ধরে প্রতিমা বানাতে বা পুজো করতে শেখাননি। পাড়ার মণ্ডপে ঠাকুর তৈরির সময় দাঁড়িয়ে থাকতেন সেই ছেলেবেলা থেকে। চোখের পলক পড়ত না। বাড়িতে এসে কাদামাটি নিয়ে ঠাকুর বানাতে বসে যেতেন। কম বকুনি শুনতে হয়নি তার জন্য। কিন্তু একটা সময় বড়রা দেখতে পান, ছোট্ট শুভর প্রতিমা যেন বড় বড় চোখ মেলে চাইছে। লক্ষ্মী, সরস্বতী দিয়ে শুরু করে এক সময়ে একচালায় সপরিবারে উমা এসে যান ঢোলে বাড়ির বারান্দায়। তখন সবে উচ্চমাধ্যমিক দিয়েছেন শুভ। ওঁর মনের ইচ্ছাটা এক দিন বাড়ির বড়দেরও ইচ্ছা হয়ে ওঠে— পুজো হবে বাড়িতে। পাঁচ বছর ধরে সেটাই চলছে।
নিজেই পটুয়া। বাড়িতেই একচালা প্রতিমা বানান সৌগত।
পুজো তো হবে। কিন্তু তত দিনে বাড়ির বড়দের জানা হয়ে ওঠেনি মনে মনে আরও একটা ইচ্ছা পুষে রেখেছে একরত্তি ছেলেটা। নিজের বানানো প্রতিমার পুজো নিজেই করতে চায় সে। এত দিন বাড়িতে বা পাড়ায় নানা পুজো দেখতে দেখতে চুপিচুপিই সে শিখে নিয়েছিল পুজোর নিয়মকানুন, আদবকায়দা। তবু একটু প্রশিক্ষণের তো দরকার। বৈদ্যবাটিতেই থাকেন নবকুমার ভট্টাচার্য। বাংলার পুরোহিত প্রশিক্ষণের প্রবক্তার বাড়ি চতুষ্পাঠী লেনে। তাঁর কাছে শুভ যেতে শুরু করেন পুজোর পাঠ নেবেন বলে। এখন পুরোপুরি পুরোহিত হয়ে উঠেছেন শুভ। নবকুমারের কথায়, “ওঁর আগ্রহ দেখেই আমি শেখাতে রাজি হয়ে যাই। আর পাঁচটা ছেলের থেকে সৌগত একেবারেই আলাদা। সত্যিই খুব কম সময়ে রপ্ত করে নেয় দুর্গাপুজোর মতো কঠিন আচার অনুষ্ঠান। খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো করে সৌগত।”
কিন্তু হিন্দু ধর্মে শূদ্রের কি পুজো করার অধিকার রয়েছে? ‘দুর্গাপুজোর নিয়মকানুন’ গ্রন্থের প্রণেতা নবকুমার বললেন, “হিন্দু ধর্মাচারের রীতি অনেক উদার। যাঁরা জানেন না, তাঁরাই ও সব বলেন। ব্রাহ্মণ অন্যের বাড়ির পুজো করবেন। কিন্তু নিজের বাড়িতে পুজো করার জন্য ব্রাহ্মণ হতে হয় না। উপবীতেরও দরকার পড়ে না। ‘ভবিষ্যোত্তরীয় পুরাণ’-এ বলা রয়েছে, ‘ব্রাহ্মণৈঃ ক্ষত্রিয়ৈর্বৈবশ্যৈঃ শূদ্রৈরন্যৈশ্চ সেবকৈঃ এবং নানাম্লেচ্ছগণৈঃ পূজ্যতে সর্ব্বদস্যুভিঃ।।’ অর্থাৎ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং ম্লেচ্ছ সকলরেই আরাধ্য দেবী দুর্গা। সকল বর্ণের ভক্তই পুজো করার অধিকারী।”
এত শাস্ত্র নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নন সৌগত। তিনি বলেন, “আমার মন আর আমার পরিবারের সায় পেয়েই আমি পুজো করি। নিষ্ঠাভরে পুজোর আয়োজন করি। করোনার জন্য গত বছর ঢাকি আসেননি, সবার জন্য খিচুড়ি ভোগ হয়নি, কিন্তু পুজোর আয়োজনে কোনও খামতি রাখিনি। এ বারেও তাই হবে। আমার বন্ধুরা আসবে। আত্মীয়, প্রতিবেশীরা তো বটেই। সবাই মিলে পুষ্পাঞ্জলি দেব। আমি সব সময় সঠিক নিয়ম মানতে এবং সঠিক উচ্চারণে মন্ত্রপাঠের চেষ্টা করি।”
সৌগতর লেখাপড়ার বিষয় অ্যাকাউন্টেন্সি। এ বার তৃতীয় বর্ষ হয়ে গেল। ফল প্রকাশের পরে এমএ-তে ভর্তি হতে হবে, এখন থেকে চাকরির চেষ্টাও করতে হবে। কিন্তু আপাতত সে ভাবনা নেই। ওঁর মনে মনে আগামনী বেজে গিয়েছে। সোমবার জন্মাষ্টমী। গোয়ালা বংশের শুভর বাড়িতে রাধাকৃষ্ণের পুজো। সে দিনই কাঠামো পুজো করে প্রতিমা তৈরি শুরু হবে। খড়-মাটি দিয়ে মৃন্ময়ী মায়ের অঙ্গগঠন, অঙ্গরাগ হবে। মহালায়ায় চক্ষুদান। তার পরে প্রাণ প্রতিষ্ঠা।
একমেটে, দোমেটে হয়ে বোধন থেকে বিসর্জন। বৈদ্যবাটির চক গোয়ালাপাড়ার সবটাই ‘শুভ’ক্ষণ।