‘সিজ়ারিয়ান সেকশন’ হয়েছে রোগিণীর, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালের নথিতে লেখা হয়েছে ‘অ্যাপেন্ডেক্টমি!’ স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের ওয়েবসাইটেও সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল ‘অ্যাপেন্ডেক্টমি’ দেখিয়ে বিমা সংস্থার থেকে টাকা নিয়েছে।
আবার রোগিণী হয়তো অন্য অসুখ নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যসাথীতে সেই চিকিৎসার পাশাপাশি অপ্রয়োজনে ‘অ্যাপেন্ডিক্স’ কেটে বাদ দিয়েছে হাসপাতাল।
রাজ্যের অন্তত ৮টি বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে সম্প্রতি এই ধরনের কারচুপি ধরেছে স্বাস্থ্য দফতর। হাসপাতালগুলি মূলত মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও বাঁকুড়া জেলার। স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘রোগীদের বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যকর্তারা তদন্ত করছেন। অ্যাপেন্ডেক্টমি নিয়ে ভুল তথ্য দেওয়া ও অপ্রয়োজনে এই অস্ত্রোপচার করায় একটি হাসপাতালকে অনির্দিষ্টকালের জন্য, একটিকে দু’মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। অন্যদের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এখন এই প্রকল্পে যে কোনও অস্ত্রোপচারের আগে স্বাস্থ্য দফতরকে যাবতীয় তথ্য জানিয়ে আগাম অনুমতি নিতে হচ্ছে। কোনও কেস নিয়ে সন্দেহ তৈরি হলে তাই রোগী হাসপাতালে থাকাকালীনই স্বাস্থ্যকর্তারা সেখানে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন।’’
অতীতে অপ্রয়োজনে চোখের ছানির অস্ত্রোপচার, সিজ়ার, জরায়ু বাদ দেওয়ার ঘটনা ধরা পড়েছিল স্বাস্থ্যসাথীর ‘ফ্রড ডিটেকশন মেকানিজম’-এ। এর পরেই স্বাস্থ্য দফতর নিয়ম করে, এই প্রকল্পের আওতায় ছানি অস্ত্রোপচার ও ‘সিজ়ার’ করতে হলে আগে সরকারি হাসপাতালে যেতে হবে। তারা কোনও কারণে তা করতে না-পারলে লিখিত ভাবে জানাবে। সেই কাগজ দেখিয়ে বেসরকারি জায়গায় অস্ত্রোপচার হবে। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, এর পর গত কয়েক মাসে বেসরকারি হাসপাতাল ও নার্সিংহোমে স্বাস্থ্যসাথীতে ‘সিজ়ার’ প্রায় ২২ শতাংশ এবং ছানির অস্ত্রোপচার প্রায় ৪৫ শতাংশ কমে। এর পরই কোনও কোনও জায়গায় অতিরিক্ত সংখ্যায় ‘অ্যাপেন্ডেক্টমি’-র ঘটনা স্বাস্থ্যকর্তাদের নজরে আসে।
এক স্বাস্থ্যকর্তা জানান, যাঁদের ‘অ্যাপেন্ডেক্টমি’ হয়েছে, তাঁদের বাড়ি-বাড়ি ঘোরেন দফতরের অফিসারেরা। দেখা যায়, প্রায় প্রত্যেকেরই সদ্যোজাত শিশু রয়েছে, যার বয়সের সঙ্গে ‘অ্যাপেন্ডেক্টমি’র সময় মিলে যাচ্ছে। তদন্তে ধরা পড়ে যায় কারচুপি।
স্বাস্থ্য দফতরের ব্যাখ্যায় প্রথমত, নতুন নিয়মে ‘সিজ়ার’ কমেছে বলে কিছু বেসরকারি হাসপাতালের আয় কমেছে। আয় বাড়াতে ‘সিজ়ার’-কে তারা ‘অ্যাপেন্ডেক্টমি’ দেখিয়ে প্যাকেজের টাকা নিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রোগীপক্ষেরও সায় থাকছে। দ্বিতীয়ত, অনেক সময়ে কোনও নাবালিকা সন্তানের জন্ম দিচ্ছে। তা ঢাকতেও ‘অ্যাপেন্ডেক্টমি’ বলে চালানো হচ্ছে। স্বাস্থ্যসাথীর পরিসংখ্যানেই দেখা যাচ্ছে, ১০-১৯ বছরের মেয়েদের মধ্যে ‘অ্যাপেন্ডেক্টমির’ হার ৩২%। আবার ওই একই বয়সসীমায় ‘সিজ়ার’ হয়েছে ২১% মেয়ের।
সাসপেন্ড হওয়া একটি হাসপাতাল নদিয়ার করিমপুরে। সেখানকার এক কর্তা সুখেন্দুকুমার মণ্ডলের দাবি, ‘‘যাঁর প্রয়োজন শুধু তাঁরই অ্যাপেন্ডেক্টমি করি। স্বাস্থ্যকর্তারা অহেতুক অপরাধী বানাতে চাইছেন। তাই ওঁরা সাসপেন্ড করার আগে আমরাই স্বাস্থ্যসাথী থেকে বেরিয়ে এসেছি।’’ দু’মাস সাসপেন্ড হওয়া মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার একটি হাসপাতালের কর্তা রাকিব হোসেনেরও দাবি, ‘‘আমাদের সার্জনরা বাইরে থেকে এসে অস্ত্রোপচার করে যান। স্থায়ী আরএমও ছিল না বলে সাসপেন্ড হয়েছিলাম। অ্যাপেন্ডেক্টমি নিয়ে সমস্যা হয়নি।’’ স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য ওই দাবি উড়িয়ে দিয়েছেন।