সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে কালীঘাটের কাকু। — ফাইল চিত্র ।
এ বার শেয়ারের দামে কারচুপি করার অভিযোগ ‘কালীঘাটের কাকু’ ওরফে সুজয়কৃষ্ণ ভদ্রের সঙ্গে যোগ থাকা বেসরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে! কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) সূত্রে এমনটাই জানা গিয়েছে। তদন্তকারী ইডি আধিকারিকেরা মনে করছেন, সুজয়ের সঙ্গে যোগ থাকা ওই সংস্থার প্রতিটি শেয়ার আসল মূল্যের তুলনায় অত্যাধিক চড়া দামে বিক্রি করা হয়েছিল। অভিযোগ, ১০ টাকার শেয়ারগুলি বিক্রি করা হয়েছিল প্রায় ৪৪০ টাকায়। এ ভাবে শেয়ার বিক্রি করে বিভিন্ন সংস্থার থেকে প্রায় ৩ কোটি টাকা তোলা হয়েছিল বলে ইডি সূত্রে খবর। এ ছাড়াও হাওয়ালার মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে প্রায় ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার অভিযোগ রয়েছে ওই সংস্থার বিরুদ্ধে।
পাশাপাশি, ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, সুজয়কৃষ্ণের সঙ্গে যোগ থাকা সংস্থায় টাকা ঢেলেছিল অন্য তিন সংস্থা। ওই তিন সংস্থার প্রায় ৩ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছিল। ওই তিন সংস্থার মধ্যে দু’টি সংস্থা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে ইডি সূত্রে খবর।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে খবর, যে সংস্থাগুলি সুজয়কৃষ্ণের সঙ্গে যোগ থাকা সংস্থায় বিনিয়োগ করেছিল, তাদের ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খতিয়ে দেখে বেশ কিছু ‘রহস্যজনক’ লেনদেনের হিসাব মিলেছে। পাশাপাশি, ওই সংস্থাগুলি ঠিক কী ধরনের সংস্থা ছিল তা-ও খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন ইডি আধিকারিকেরা। ইডি মনে করছে, এই সংস্থাগুলির সঙ্গে সুজয়কৃষ্ণের যোগ থাকতে পারে। তা খুঁজে বার করতে ইতিমধ্যেই তদন্ত শুরু হয়েছে বলে ইডি সূত্রে খবর।
ইডি এ-ও মনে করছে, সুজয়কৃষ্ণের সঙ্গে যোগ থাকা একাধিক সংস্থা থেকে নামে-বেনামে বিনিয়োগ করা হয়েছিল ওই বেসরকারি সংস্থায়। ইডি সূত্রে খবর, ওই বেসরকারি সংস্থার নামে থাকা সম্পত্তিগুলি খতিয়ে দেখতে শুরু করেছেন তদন্তকারী আধিকারিকেরা।
প্রসঙ্গত, গত ১৪ জুন কলকাতার নগর দায়রা আদালতে ইডির আইনজীবী ফিরোজ এডুলজি জানিয়েছিলেন, হাওয়ালার মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থায় টাকা ঘুরেছে। ইডির অভিযোগ, সুজয়কৃষ্ণের সঙ্গে যোগ থাকা ওই সংস্থার মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে এক কোটি টাকার। হাওয়ালার মাধ্যমে বিভিন্ন খাতে প্রায় ১০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। সুজয়কৃষ্ণ চারটি সংস্থা নিয়ন্ত্রণ করতেন বলেও আদালতে দাবি করেছিল ইডি। ইডির আইনজীবী আদালতে জানিয়েছিলেন, হাওয়ালার টাকা আবাসন শিল্পে বিনিয়োগ করা হয়েছে। তার মধ্যেই আবার শেয়ারের দরে কারচুপির অভিযোগ উঠল ‘কালীঘাটের কাকু’র সঙ্গে যোগ থাকা ওই সংস্থার বিরুদ্ধে।
পাশাপাশি, ৭ জুলাই কাকুর গলার স্বর পরীক্ষা করার জন্য শুনানির দিন ধার্য হয়েছে।
অভিযোগ উঠেছিল, সুজয়কৃষ্ণের নির্দেশে তাঁরই ফোন থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মুছে দিয়েছিলেন পেশায় সিভিক ভলান্টিয়ার রাহুল বেরা! সেই রাহুলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য কলকাতার ইডি দফতরে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। সেই মতো ইডির দফতর সিজিও কমপ্লেক্সে হাজিরাও দেন বিষ্ণুপুরের সিভিক ভলান্টিয়ার রাহুল। ইডি সূত্রের খবর, ফোনের তথ্য মোছার বিষয়ে তো বটেই, সুজয়ের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক কেমন ছিল, সুজয়ের নির্দেশে তিনি নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে কোনও ভূমিকা নিয়েছিলেন কি না— এই সব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় রাহুলকে। সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখতেই সুজয়কৃষ্ণের গলার স্বর পরীক্ষা করে দেখা হবে বলে ইডি সূত্রে খবর।
আগে যা ঘটেছে
রাজ্যে শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে গত ৩০ মে প্রায় ১২ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদের পর সুজয়কৃষ্ণ ভদ্র ওরফে ‘কালীঘাটের কাকু’কে গ্রেফতার করে ইডি। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার দাবি, নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত কুন্তল ঘোষের সঙ্গে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের সেতুবন্ধনের কাজ করেছিলেন সুজয়। মানিক ভট্টাচার্যের সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। ২০১৮ সাল থেকে এই দুর্নীতিতে ‘কাকু’ জড়িত বলে দাবি করেছে ইডি। তদন্তকারীরা আরও দাবি করেছেন, জেরায় কুন্তল জানিয়েছেন, পার্থের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে তাঁর কাছ থেকে প্রথমে ৭০ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন সুজয়। সুজয়ের কথাতেই তিনি পার্থকে আরও ১০ লক্ষ টাকা দেন। বর্তমানে ১৪ দিনের ইডি হেফাজতে রয়েছেন সুজয়।
শিক্ষায় নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে সিবিআই গ্রেফতার করে বেসরকারি শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ সংগঠনের নেতা তাপস মণ্ডলকে। তাঁর মুখেই প্রথম ‘কালীঘাটের কাকু’র কথা শোনা যায়। নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত তদন্তে নাম এসেছে গোপাল দলপতির। তাঁর মুখেও ‘কাকু’র নাম শোনা গিয়েছিল। এর পরেই গোয়েন্দাদের আতশকাচের তলায় আসেন সুজয়।
সিবিআই সুজয়কে দু’বার তলব করে। প্রথম বার সিবিআই দফতরে গিয়ে হাজিরা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পরের বার নিজের আইনজীবীকে দিয়ে নথিপত্র পাঠিয়েছিলেন। সেই সময় সুজয় জানিয়েছিলেন, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার পক্ষে তাঁর কাছে কিছু নথি চাওয়া হয়েছিল। সেগুলি তিনি আইনজীবী মারফত পাঠিয়েও দিয়েছেন সিবিআই দফতরে। একই সঙ্গে সুজয় দাবি করেছিলেন, তাঁর স্ত্রী-কন্যার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের নথিও তিনি পাঠিয়েছেন আইনজীবীর মাধ্যমে।
গত ২০ মে সুজয়ের বেহালার ফকিরপাড়া রোডের ফ্ল্যাট, বাড়ি, অফিস-সহ বহু জায়গায় তল্লাশি চালায় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। ওই দিনই নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত কুন্তল ঘোষের চিঠি সংক্রান্ত মামলায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে জিজ্ঞাসাবাদ করে সিবিআই। সুজয় এক সময় অভিষেকের অফিসে কাজ করতেন। ‘কাকু’র সঙ্গে সংযোগ রয়েছে এমন ৩টি সংস্থাতেও তল্লাশি চালিয়েছিল ইডি। সেই সংস্থার মাধ্যমে কালো টাকা সাদা করা হয়েছে কি না, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ওই ৩টি সংস্থার মধ্যে একটি সংস্থা বিশেষ করে নজরে রয়েছে তদন্তকারীদের। সেই সংস্থা ‘কালীঘাটের কাকু’ নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে তদন্তকারীদের ধারণা। ওই সংস্থাগুলির ডিরেক্টর এবং অ্যাকাউন্টট্যান্টদের তলব করা হয় আগেই। এর পরেই ৩০ মে তলব করা হয় সুজয়কে। নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা সংস্থার কাছ থেকে ৪০ লক্ষ টাকা মূল্যের জমিতে বিনিয়োগ করেছিলেন কাকু। এ ছাড়াও নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে উঠে আসা বেশ কিছু তথ্য নিয়ে সুজয়কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে ইডি সূত্রে খবর। তার আগে, গত ৪ মে সুজয়ের ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়েছিল সিবিআই। সেই তল্লাশি অভিযানে সুজয়ের বাড়ি থেকে কয়েক লক্ষ নগদ টাকা বাজেয়াপ্ত করে সিবিআই। তিনি অবশ্য দাবি করেছিলেন, তাঁর বোন হাসপাতালে ভর্তি। চিকিৎসার বিল মেটানোর জন্য ওই অর্থ তুলেছিলেন। পাওয়া গিয়েছিল একটি অ্যাডমিট কার্ডও। সুজয় দাবি করেছিলেন, সেটা পুরসভায় চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁর শ্যালিকার পুত্রের অ্যাডমিট কার্ড। সুজয়ের একটি ফোনও বাজেয়াপ্ত করা হয়।
নিয়োগ দুর্নীতিতে ধৃত তাপস সিবিআইয়ের কাছে দাবি করেছিলেন, অযোগ্য প্রার্থীদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কুন্তল বলতেন, ‘‘কালীঘাটের কাকুর সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে। চিন্তার কোনও কারণ নেই।’’ ইডি সূত্রে খবর, পরে গোপাল আর তাপসকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, কুন্তলের ওই ‘কালীঘাটের কাকু’ রাজ্যের এক প্রভাবশালী শীর্ষনেতার সংস্থার চিফ এগ্জ়িকিউটিভ অফিসার (সিইও)। তার পর থেকেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আতশকাচের তলায় সুজয়। যদিও কুন্তল দাবি করেছিলেন, তিনি ওই ‘কাকু’কে চেনেন না। কুন্তল এ-ও দাবি করেন, যে সুজয়কে নিয়ে আলোচনা চলছে, তিনি ‘কালীঘাটের কাকু’ নন। সুজয় নিজে দাবি করেছিলেন, কেন তাঁকে ‘কালীঘাটের কাকু’ বলা হচ্ছে, তা তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়। নিয়োগ দুর্নীতিকাণ্ডে তাঁর কাছে কোনও টাকা জমা পড়েনি বলেও দাবি করেন সুজয়। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার কর্মস্থল নিউ আলিপুর। ‘কালীঘাটের কাকু’ কথাটা কোথা থেকে এল, আমার পক্ষে সেটা বলা সম্ভব নয়। যাঁরা এটা বলছেন, তাঁরাই এর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন।’’