ইউক্রেনের উপর রুশ আগ্রাসনের কারণে রাশিয়া এবং চিনের গুপ্তচরদের আস্তানা হয়ে উঠছে সুইৎজ়ারল্যান্ড। আল্পস পর্বতমালা এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা এই দেশ ক্রমাগত আস্তানা হয়ে উঠেছে দু’দেশের দুঁদে গুপ্তচরদের! সোমবার এমনটাই দাবি করেছে সুইস সরকার।
সুইৎজ়ারল্যান্ডে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয় রয়েছে। আর সেই কারণেও সেই দেশ গুপ্তচরদের বিশেষ আকর্ষণের জায়গা বলে মনে করছে সে দেশের প্রশাসন।
সুইৎজ়ারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘ফেডারেল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস (এফআইএস)’ তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, ইউরোপে শান্তির পরিবেশ ধ্বংস করছে রাশিয়া।
এফআইএস বলেছে, “শান্তি এবং নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির কার্যকারিতা ইউরোপে ক্রমশই কমে যাচ্ছে। স্থিতিশীল বিশ্বব্যবস্থার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।”
এফআইএসের দাবি, বিশ্বের প্রধান শক্তিগুলির ক্রমবর্ধমান প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে সুইৎজ়ারল্যান্ডের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে তা আরও বেড়েছে বলেও তাদের দাবি।
এই সুইস গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, আমেরিকা এবং চিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে বিশ্বের দ্বিমেরুকরণ হচ্ছে। অর্থাৎ দু’টি অন্যতম শক্তির কারণে বিশ্ব দু’ভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
তবে ইউক্রেনের যুদ্ধ সুইৎজ়ারল্যান্ডের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করার মূলে রয়েছে বলেও দাবি করছে সুইস প্রশাসন।
এফআইএস আরও জানিয়েছে, প্রধানত রুশ এবং চিনা গুপ্তচরদের কারণে বর্তমানে সব থেকে বেশি সমস্যায় সুইৎজ়ারল্যান্ডের নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
বিবৃতি জারি করে এফআইএস জানিয়েছে, ইউরোপের মধ্যে সুইৎজ়ারল্যান্ড এমন একটি দেশ যেখানে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রুশ গোয়েন্দা কূটনীতিকের ছদ্মবেশে কাজ করেন।
রাষ্ট্রপুঞ্জের অন্যতম সদর দফতর সুইৎজ়ারল্যান্ডের জেনেভাতে। রাষ্ট্রপুঞ্জের বেশ কয়েকটি সংস্থার সদর দফতরও এই শহরেই। এর ফলে বহু দেশের বহু কূটনীতিক বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নেওয়ার নাম করে নিয়মিত ভাবে জেনেভায় জড়ো হন।
এফআইএস প্রধান ক্রিশ্চিয়ান ডাসি একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘‘জেনেভা এবং বার্নে রাশিয়ার প্রায় ২২০ জন স্বীকৃত কূটনীতিক বা প্রশাসনিক আধিকারিক রয়েছেন।’’ তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ গুপ্তচর হিসাবে কাজ করতে পারেন বলে উদ্বেগ সুইস গোয়েন্দা বিভাগের।
এফআইএসের দাবি, রুশ-ইউক্রেন সংঘাতের পর রাশিয়া বেশ কয়েকটি দেশের সংস্থাকে নিজেদের প্রয়োজনীয় জিনিপসত্র আমদানি করার জন্য ব্যবহার করেছে। এর মধ্যে রয়েছে তুরস্ক এবং ভারতের মতো দেশও। আর সেই কারণে সুইৎজ়ারল্যান্ডে নজরদারি বেড়েছে।
সুইস গোয়েন্দাদের বিশ্বাস সুইৎজ়ারল্যান্ডের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছেন চিনের গুপ্তচরেরাও। রাশিয়ার মতো চিনও সে দেশে কয়েক ডজন গুপ্তচর পাঠিয়েছে বলে দাবি করেছে এফআইএস।
তবে কোনও ভাবেই মস্কোর গুপ্তচরদের মতো কূটনীতিকের ছদ্মবেশে নেই চিনা গুপ্তচররা। বরং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা পরিচয় লুকিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছেন বলে সুইৎজ়ারল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থার দাবি।
এফআইএসের দাবি, মূলত বিজ্ঞানী, সাংবাদিক বা ব্যবসায়ী হিসাবে পরিচয় দিয়ে সুইৎজ়ারল্যান্ডে ঘাঁটি গেড়েছেন চিনের গুপ্তচররা।
এফআইএস প্রধান ক্রিশ্চিয়ান ডাসির মতে, ধীরে ধীরে ইউরোপে আরও জাঁকিয়ে বসবেন চিনের গোয়েন্দারা। সে দেশের গুপ্তচরেরা সুইৎজ়ারল্যান্ডে টিকে থাকার জন্য আরও উপায় এবং সংস্থান বৃদ্ধি করবেন বলেও তিনি দাবি করেছেন।
এফআইএস প্রধান আরও বলেন, ‘‘আমরা প্রচণ্ড চেষ্টা করছি, যাতে বাইরের দেশের গুপ্তচরবৃত্তির রমরমা কমানো যায়।’’ সুইৎজ়ারল্যান্ডে গুপ্তচরবৃত্তি জেনেভার আন্তর্জাতিক গুরুত্বের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং সুইৎজ়ারল্যান্ডের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।
সম্ভবত রাষ্ট্রপুঞ্জের সিদ্ধান্তের উপর নজরদারি চালাতে এবং অন্যতম ধনী দেশ হিসাবে পরিচিত সুইৎজ়ারল্যান্ডের উপর প্রভাব বিস্তার করতে চিন এবং রুশ গুপ্তচরেরা চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেই মনে করছেন সুইস গোয়েন্দা বিভাগের আধিকারিকেরা।
সম্প্রতি রাশিয়ায় পুতিন সরকারের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে ‘ওয়াগনার’ গোষ্ঠী। মস্কো নিজেদের দখলে নিতে অভিযানও শুরু করেছিল ‘ওয়াগনার’ বাহিনী। তবে শেষ পর্যন্ত তারা পিছিয়ে আসে। এই ঘটনা থেকে অনেক শেখার আছে বলেও দাবি এফআইএস প্রধানের।
মস্কো এবং ‘ওয়াগনার’ বাহিনীর দ্বন্দ্বকে রাশিয়ার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে জানিয়েছেন এফআইএস প্রধান ডাসি।