ভুল কবুল করছেন। কিন্তু সেটাকে চিকিৎসার গাফিলতি বলতে নারাজ শল্যচিকিৎসক। অথচ চিকিৎসকদের অনেকেরই অভিমত, একটি প্রত্যঙ্গে অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে অন্য অঙ্গকে জখম করে দেওয়ার পরে কোনও অজুহাতই দেখানো চলে না।
কথাটা উঠছে অ্যাপেনডিক্স অস্ত্রোপচার করাতে গিয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে আঘাত লাগায় বনগাঁর এক মহিলার বিড়ম্বনার সূত্রে। অ্যাপেনডিক্স অস্ত্রোপচারের পরেও তাঁর তলপেটের তীব্র ব্যথা কমেনি। কয়েক দিন পর্যবেক্ষণে রাখা সত্ত্বেও শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হচ্ছিল। বাধ্য হয়ে বনগাঁর নার্সিংহোম থেকে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় বনগাঁবাসিনী শিখা ভদ্রকে। সেখানেই জানা যায়, অস্ত্রোপচারের সময়ে আঘাত লেগে ক্ষুদ্রান্ত ফুটো হয়ে গিয়েছে তাঁর। অস্ত্রোপচারের পরে ছ’মাস কেটে গিয়েছে। এখনও পুরো সুস্থ হতে পারেননি তিনি। চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ তুলে পুলিশ আর রাজ্য মেডিক্যাল কাউন্সিলের দ্বারস্থ হয়েছে তাঁর পরিবার।
গত ৫ জুলাই বনগাঁর নার্সিংহোমে অস্ত্রোপচার হয়েছিল শিখাদেবীর। তাঁর মেয়ে সোনালি ভদ্রের অভিযোগ, অস্ত্রোপচারের পরে এক সপ্তাহ ওই নার্সিংহোমে ছিলেন তাঁর মা। প্রতিদিন অবস্থার একটু একটু করে অবনতি হচ্ছিল। ১১ জুলাই কলকাতা মেডিক্যালে আনা হয় তাঁকে। দীর্ঘ চিকিৎসার পরে সম্প্রতি সেখান থেকে ছাড়া পেয়েছেন তিনি। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছেন, আরও অনেক দিন চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, তাঁর যা হয়েছে, তাকে চিকিৎসা পরিভাষায় বলে ‘আইলিয়াল পারফোরেশন’ অর্থাৎ ক্ষুদ্রান্ত্রে ফুটো।
শিখাদেবীর মেয়ের কথায়, ‘‘ডাক্তারের ভুলে আমার মাকে যে-খেসারত দিতে হচ্ছে, তা যাতে আর কাউকে দিতে না-হয়, সেই জন্যই আমরা ওই নার্সিংহোমের সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের শাস্তি চাই। সেই জন্যই পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ জানিয়েছি মেডিক্যাল কাউন্সিলে।’’
যিনি শিখাদেবীর অস্ত্রোপচার করেছিলেন, সেই চিকিৎসক স্বাগত দাস বলেন, ‘‘রোগীর ক্ষুদ্রান্ত্র আর অ্যাপেনডিক্স আলাদা করতে গিয়ে ভুলবশত ক্ষুদ্রান্ত্রে আঘাত লেগেছিল। তখন বিষয়টি আমি বুঝতে পারিনি। কয়েক দিন পর্যবেক্ষণে রাখার পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় দেরি না-করে রোগীকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করি।’’
রোগীর পরিবার অভিযোগ আনলেও এই ঘটনাকে চিকিৎসার গাফিলতি বলে মানতে রাজি নন স্বাগতবাবু। তাঁর দাবি, অস্ত্রোপচারের সময় এই ধরনের ভুল হতেই পারে।
কী বলছেন অন্য চিকিৎসকেরা?
চিকিৎসকদের একটা বড় অংশই মনে করছেন, এমন ভুলের সমর্থনে কোনও যুক্তি খাড়া করা ঠিক নয়। এটা হয় মূলত অসাবধানতা থেকেই। এসএসকেএমের গ্যাস্ট্রোএন্টেরোলজি বিভাগের প্রধান গোপালকৃষ্ণ ঢালির কথায়, ‘‘চিকিৎসকের সামান্য ভুল এই ধরনের অস্ত্রোপচারের সময়েও রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের অভিজ্ঞতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’
একই কথা বলেছেন হেপাটো প্যাংক্রিয়াটো বিলিয়ারি সার্জেন শুদ্ধসত্ত্ব সেন। তিনি বলেন, ‘‘অ্যাপেনডিক্স অস্ত্রোপচারকে কখনওই অবজ্ঞা করা উচিত নয়। অভিজ্ঞ শল্যচিকিৎসকের কাছেই যাওয়া উচিত।’’ শল্যচিকিৎসক দেবাশিস রায় জানান, প্রতি এক হাজার অ্যাপেনডিক্স অস্ত্রোপচারের সময় দু’তিনটি অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে যায়। অ্যাপেনডিক্স আর ক্ষুদ্রান্ত্র পরস্পরকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে। চিকিৎসক সামান্য অসতর্ক হলেই অ্যাপেনডিক্স আলাদা করতে গিয়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে ফুটো হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
শিখাদেবীর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ঠিক কতটা মারাত্মক হয়ে গিয়েছিল?
মেডিক্যালের চিকিৎসকেরা জানান, শিখাদেবীর অ্যাপেনডিক্স অস্ত্রোপচারের সময়ে ক্ষুদ্রান্ত্রে শুধু আঘাতই লাগেনি। ক্ষুদ্রান্ত্র রীতিমতো ফুটো হয়ে গিয়েছিল। ফলে সংক্রমণের সৃষ্টি হয়। অস্ত্রোপচারের সময় খাদ্যনালিতে ক্ষত সৃষ্টি হলে মলদ্বার দিয়ে না-বেরিয়ে মল পেটের সংক্রমিত অংশ দিয়ে বেরিয়ে আসে। পচন এড়াতে পেটের সংক্রমিত অংশ দিয়ে মল যাতে না-বেরোয়, তার জন্য ওই অংশ দিয়ে একটি পাইপ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এবং ওই পাইপের মাধ্যমে মল বাইরে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। এই পদ্ধতির নাম ‘আইলিও স্টোমি’। ঘা শুকিয়ে গেলে আইলিও স্টোমি খুলে নিয়ে রোগী স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারেন। শিখাদেবীর ক্ষেত্রে এই চিকিৎসাই করা হয়েছে। তবে তাঁর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে এখনও অনেক সময় লাগবে বলে জানিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।