মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সীতারাম ইয়েচুরি। ফাইল চিত্র।
জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপির মোকবিলায় অনেক সময়ে তাঁরা এক বন্ধনীতে। আবার রাজ্য রাজনীতিতে তাঁদের দল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। এ বারের পুজোর কলকাতায় মণ্ডপের আশেপাশেও লড়াই চলছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সীতারাম ইয়েচুরির! প্রথম জনের অস্ত্র একাধিক, দ্বিতীয় জনের একটিই!
উৎসবমুখী জনতার কাছে পৌঁছতে পুজোর মণ্ডপ চত্বরে পুস্তক বিপণি খোলা বামপন্থী দলগুলির বহু দিনের রেওয়াজ। সিপিএমের বইয়ের বিপণি মূলত হয় ন্যাশনাল বুক এজেন্সির (এনবিএ) মারফত। বেশির ভাগ বইও আসে সেখান থেকে। অন্য দিকে, তৃণমূল কংগ্রেসও সাম্প্রতিক কালে তাদের মুখপত্রের নামে বিপণি আরও ছড়িয়ে দেওয়ার দিকে নজর দিয়েছে। দুই সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, এই দু’ধরনের বিপণিতে যাঁদের বইয়ের চাহিদা এ বার বেশি, তাঁদের মধ্যে উপরের দিকে আছেন এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক।
লক্ষ্যণীয় বিষয়, রাজনীতির ময়দানে এখন ‘দুর্নীতি’, ‘অপশাসন’ বা ‘বেহাল অর্থনীতি’র প্রশ্ন দাপিয়ে বেড়ালেও পুজোর বইয়ের জগতের ধারা অন্য রকম। চাহিদায় উপরে থাকা দু’জনের কেউই কিন্তু খুব নতুন বা অভিনব বিষয়ের উপরে লেখেননি। ইয়েচুরির বইয়ে দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরোনো উপলক্ষে ইতিহাস এবং স্বাধীনতার মূল্য বিশ্লেষণ আছে। আর অন্য দিকে, বাম আমলে বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতার আন্দোলনের কাহিনি তাঁর নিজের জবানিতে যেখানে লেখা আছে, সেই রকম বই মানুষ খুঁজছেন। দুই শিবিরের নেতারাই মনে করছেন, অন্য সময়ে সমাজ মাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমে চোখ রাখা জনতা পুজোর বিপণিতে এসে সংগ্রহে রাখার মতো বই দেখে নিচ্ছেন। যে বিষয় তাঁদের মন ছুঁতে পেরেছে, সেই রকম বইয়ের চাহিদাই দেখা যাচ্ছে বেশি।
এনবিএ-র অধিকর্তা অনিরুদ্ধ চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘সীতারাম ইয়েচুরির ‘স্বাধীনতা ৭৫’ বইটির চাহিদা এখনও পর্যন্ত খুব ভাল। সফদর হাসমির বইয়ের বিক্রিও ভাল হচ্ছে। অতিমারি-জনিত পরিস্থিতিতে দু’বছর ধাক্কা খাওয়ার পরে এ বার বিপণির সংখ্যা বেড়েছে, মানুষের সাড়াও ভাল। স্টল খুলে দেওয়ার পরে আমরা বুঝতে পারলাম, বই আরও বেশি করে ছাপানো দরকার ছিল!’’ কলকাতার এই বই-কাহিনি জেনে কেরল থেকে ইয়েচুরির মন্তব্য, ‘‘আনন্দের কথা! এই অপপ্রচার এবং ইতিহাস বিকৃতির সময়ে মানুষ যত বই পড়ে সঠিক দৃষ্টিকোণ গ্রহণ করেন, তত ভাল।’’
চোখের সমস্যার কারণে এখন আর নতুন করে কলম ধরতে পারেন না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে বামফ্রন্ট সরকারের কাজ নিয়ে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ‘ফিরে দেখা’ এখনও চাহিদার তালিকায় আছে। বাগবাজার হোক বা যাদবপুর ৮বি, সিপিএমের পুস্তক বিপণিতে বুদ্ধবাবুর বইয়ের খোঁজ জারি আছে।
উল্টো দিকে, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর অতীতের কাহিনির চাহিদাও ভাল। রাজ্য তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ বলছেন, ‘‘আমাদের মুখপত্রের উৎসব সংখ্যার বিক্রি বেশি। তার পরেই মমতাদি’র বই। তরুণ প্রজন্মও এসে তৃণমূল নেত্রীর আন্দোলনের সময়ের বই নিচ্ছে। ‘পরিবর্তন’ বইটাও চলছে ভাল।’’ কুণালের মতে, ‘‘এখনকার প্রজন্মও অতীত থেকে শিখতে চায়। তাই তারা মমতাদি’র ওই সময়ের বই খুঁজছে, রেখে দেবে বলে।’’
এনবিএ-র তথ্য অনুযায়ী, রাজ্য জুড়ে এ বার ‘প্রগতিশীল ও মার্ক্সীয় সাহিত্যে’র বিপণি হয়েছে ১২০০-র বেশি। কলকাতায় গত বারের ১২০ থেকে বেড়ে এ বার বিপণি হয়েছে ১৩০। তবে সিপিএমের এরিয়া কমিটি এনবিএ-র কাছে আবেদন ও বরাত দিয়ে বই নিয়ে যাওয়ার পরে এলাকায় একাধিক স্টল খুললে তার তথ্য এক লপ্তে পাওয়া সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে সংখ্যাটা আরও বেশি। তার বাইরে সিপিএমের যুব ও ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে আরও কয়েকশো স্টল আছে। তাদের বিপণির বহর অবশ্য বাড়ে দীপাবলি উৎসবে। ‘ইয়ং ব্রিগেডে’র জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায়, সৃজন ভট্টাচার্যদের দিয়ে লেখানোর তৎপরতাও চলছে।
তৃণমূলের তথ্য বলছে, রাজ্য জুড়ে শাসক দলের মুখপত্রের বিপণি প্রায় ৬ হাজার। কলকাতার একটি ওয়ার্ডে তিনটি স্টল, জেলায় কোনও পঞ্চায়েত এলাকায় দু’টি স্টল— এমন নজিরও আছে। বই বিক্রির জন্য যেমন বরাত আসছে, তার ভিত্তিতেই এই হিসেব করছে শাসক দল।