—ফাইল চিত্র
সিঙ্গুরে তখন দুপুর। নিধিরামের ছেলের ঠিকানা খুঁজে বের করতে ঘাম ছুটছে সিঙ্গুরের বিডিও অফিসের কর্তাদের। নমিতা সাধুখাঁ-কে নিয়েও একই দশা।
এঁরা কারা? বিডিও অফিসের তালিকায় এঁরা বেড়াবেড়ি গ্রামের দুই অনিচ্ছুক কৃষক। টাটার কারখানার জন্য বাম সরকার এঁদের জমি অধিগ্রহণ করেছিল, কিন্তু সে সময় এঁরা ক্ষতিপূরণ নেননি। বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত থেকে নেবেন ক্ষতিপূরণের চেক। সঙ্গে ফেরত নেবেন জমির পরচা। সেই মতো তালিকায় আরও অনেকের সঙ্গে তাঁদের নাম উঠেছে! কিন্তু সেই তালিকার কী দশা! যেমন কমলকান্ত সাঁতরার ঠিকানা বলতে শুধু বাবার নাম, নিধিরাম! নমিতা সাধুখাঁর আবার ঠিকানার জায়গায় বাবা বা স্বামীর নামটুকুও নেই! অনেকের আবার নাম, বাবার নাম থাকলেও দাগ বা খতিয়ান নম্বর উধাও!
সব দেখেশুনে তখন ঘামছেন কর্তারা। সোমবারই মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে বলে দিয়েছেন, ৮০০ অনিচ্ছুক কৃষকের জন্য চেক তৈরি হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক মিলিয়ে ৯১১৭টি পরচা তৈরির কাজ চলছে। তা-ও বুধবারের আগেই শেষ হয়ে যাবে। প্রয়োজনে সারা রাত ধরে ফ্লাড লাইট জ্বেলে জমির পরচা ফেরত দেওয়ার কাজ চলবে বলেও জানিয়ে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।
অথচ চব্বিশ ঘণ্টা পরে, মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত সিঙ্গুর বিডিও অফিসে পৌঁছল মাত্র ৩৫৮ জনের তালিকা! তা-ও তার এই দশা! তালিকায় যাঁদের নাম আছে, তাঁদের অনেকেই এখন আর সিঙ্গুরের বাসিন্দা নন। কেউ থাকেন বেলুড়ে, কেউ কলকাতায়। জেলা প্রশাসন তখনও জানিয়ে যাচ্ছে, বাকি নামের তালিকা রাতের মধ্যেই পাঠানো হবে। কিন্তু দুপুর অবধি পাঠানো তালিকাই তো অসম্পূর্ণ। সকালের মধ্যে সবাইকে কী ভাবে হাজির করা যাবে মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে? এ তো প্রায় খড়ের গাদায় ছুঁচ খোঁজার মতো অবস্থা!
কারও নেই ঠিকানা, কারও বাবার নাম!
এমনই তালিকা নিয়ে হিমশিম বিডিও অফিসের কর্তারা।
অগত্যা সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত সদস্যদের শরণাপন্ন হলেন বিডিও অফিসের কর্তারা। তাঁদের কাছেই পাঠানো হল অনিচ্ছুক কৃষকদের তালিকা। পাঁচটি মৌজা— বেড়াবেড়ি, খাসেরভেড়ি, সিংহেরভেড়ি, গোপালনগর ১ এবং ২। পাঁচটি দল বানিয়ে দুপুর থেকে চলল ওই সব পরিবারকে চিহ্নিত করে তাঁদের খবর দেওয়ার কাজ। আজ, বুধবার সকাল থেকে ওই সব পরিবারকে হাজির হয়ে যেতে হবে সিঙ্গুর বিজয় মঞ্চের কাছে। তাঁদের প্রাতরাশ থেকে দুপুরের খাওয়া— সব ব্যবস্থাই করবে প্রশাসন। এই খবর দিয়ে নির্দিষ্ট তালিকায় সই করিয়ে নেওয়া হল কৃষক পরিবারের প্রতিনিধিদের দিয়ে।
তাতেও কি কাজ শেষ হল?
জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘হল আর কই! দুপুরের পর থেকে দফায় দফায় তালিকা পৌঁছচ্ছে বিডিও অফিসে। রাত অবধি ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক মিলিয়ে প্রায় সাড়ে সাতশো কৃষক পরিবারের তালিকা পাঠানো হয়েছে। বিডিও অফিসের কর্তারা রাতভর কাজ করছেন, যাতে সব কিছু সুষ্ঠু ভাবে সারা যায়।’’ আর নবান্ন সূত্রে খবর, শেষমেশ এক দিনে ন’হাজার পরচা কৃষকের হাতে তুলে দেওয়ার ভাবনা আপাতত মুলতুবি রাখা হয়েছে। আজ, বুধবার ৭৫০-র মতো কৃষক পরিবারের হাতে পরচা তুলে দেওয়া হবে। তার পরে কয়েক দিন ধরে ধাপে ধাপে পরচা দেওয়া হবে বাকিদেরও।
জেলা প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘তালিকা অনুযায়ী কেউ ৮ লাখ টাকার চেক পাবেন, কেউ ৪০ হাজারের। উদোর পিন্ডি যাতে বুদোর ঘাড়ে না যায়, সে জন্য যিনি চেক নেবেন, তাঁকে নির্দিষ্ট সংখ্যার ব্যাজ দেওয়া হচ্ছে। তাঁর চেক ও পরচা নিয়ে তৈরি হচ্ছে ওই সংখ্যার ফাইল। যাতে গুলিয়ে না যায়।’’ বিডিও অফিসের কর্তারা রাত জেগে সেই সব ফাইলে চেক এবং সংশ্লিষ্ট পরচা গোছানোর কাজ করছেন।
জেলার কর্তারা জানাচ্ছেন, চেক তৈরি হচ্ছে ২০০৬ সালে ওখানে জমির যা দাম ছিল, সেই হারে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনেই। যেমন, বেড়াবেড়ি গ্রামে নিধিরামের ছেলে কমল সাঁতরা তাঁর ৪০ শতক জমির জন্য পাবেন ৬ লক্ষ ৯৫ হাজার ৪৬৫ টাকা। আবার সুব্রত কুমার সাঁতরা পাবেন ৩৮ হাজার ৮৩৫ টাকা।
বেড়াবেড়ির পঞ্চায়েত প্রধান দীপঙ্কর ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা মোটামুটি সবাইকেই চিনি। তাই দুপুর থেকে নাম ধরে ধরে খবর পাঠানোর কাজ শুরু করে দিয়েছি। আশা করছি, বুধবার সকালের মধ্যে পুরোটাই শেষ করতে পারব।’’ অন্য একটা ভয় হচ্ছে দীপঙ্করবাবুদের। তিনি বলেন, ‘‘বাম আমলে জমি কিনে কেউ হয়তো ভূমি সংস্কার দফতরে মিউটেশন করেননি। অধিগ্রহণের সময় পরচায় শেষ যে ব্যক্তির নাম রয়েছে, তাঁকেই ক্ষতিপূরণ দিয়ে দিয়েছে বাম সরকার। জমির প্রকৃত মালিক কে, তার খোঁজ না করেই!’’ এখন তা নিয়ে মামলা হতে পারে, আশঙ্কা দীপঙ্করবাবুর।
সানাপাড়ার মোড়ে মূল মঞ্চের পাশেই তৈরি হচ্ছে জমিহারা কৃষকদের মঞ্চ। সেখানেই বসানো হবে অনিচ্ছুক কৃষকদের। নাম, সংখ্যা মিলিয়ে, লাইন করে বসানো হবে তাঁদের। কোনও ভাবেই যাতে ভুল না হয়। দিনভর এই পরিকল্পনা করেছেন জেলা আধিকারিকেরা। সন্ধ্যায় তা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে নবান্নে।
সব পরিকল্পনা তৈরি। উৎসবের জন্য রাত জাগছে সিঙ্গুর। কিন্তু না-আঁচালে বিশ্বাস নেই। তাই, রাত জাগছে বিডিও অফিসও।