Barun Biswas Murder Mystery

জুলাইয়ের পড়ন্ত বিকেলে হঠাৎ গুলির শব্দ, এক লহমায় শেষ এক যুগের আন্দোলন

পরদিন আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। হাসপাতাল থেকে আনা হয়েছে বরুণ বিশ্বাসের দেহ। সুটিয়া বারাসত পল্লি উন্নয়ন বিদ্যাপীঠের মাঠে সেই দেহ ঘিরে জড়ো হয়েছে ভিড়।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র  

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:০৭
Share:

গোবরডাঙা স্টেশন চত্বরে এই বটগাছের নীচ থেকে বাইক নিয়ে বেরোনোর সময়েই গুলি করা হয়েছিল বরুণ বিশ্বাসকে। —নিজস্ব চিত্র।

৫ জুলাই, ২০১২। বিকেলের রোদ পড়ে আসছে। কিন্তু গরম কমার লক্ষণ নেই। শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ-গামী ট্রেন এসে থামল গোবরডাঙা স্টেশনে। বনগাঁ লোকালের পরিচিত ভিড় ঠেলে, প্রায় যুদ্ধ করেই স্টেশনে নামলেন চল্লিশের এক যুবক। সাধারণ প্যান্ট-শার্ট পরনে। মুখে চাপ দাড়ি। স্টেশনের বাইরে মোটরবাইক রেখে রোজ ট্রেন ধরেন কলকাতার। গন্তব্য মিত্র ইনস্টিটিউশন (মেন)। ফিরে সেই বাইকেই বাড়ি যান।

Advertisement

সে দিনও ১ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরিয়ে সবে বাইকে চেপেছেন। ভিড় ঠেলে হঠাৎ এগিয়ে এল একটি নাবালক হাত। কাছের সবাই সচকিত হয়ে শুনলেন গুলির শব্দ। তার পরেই ভিড়ে মিশে গেল ওরা। ততক্ষণে বাইক থেকে লুটিয়ে পড়েছেন সেই যুবক, বরুণ বিশ্বাস। গুলি তাঁর পিঠের দিক থেকে ঢুকে পেট ফুঁড়ে চলে গিয়েছে। গুলি চালানো হয়েছিল পাইপগান থেকে। পুলিশ পরে জানায়, এক গুলিতে ‘কাজ হাসিল’ করার জন্যই ব্যবহার করা হয়েছিল পাইপগান।

পরদিন আকাশ ভাঙা বৃষ্টি। হাসপাতাল থেকে আনা হয়েছে বরুণ বিশ্বাসের দেহ। সুটিয়া বারাসত পল্লি উন্নয়ন বিদ্যাপীঠের মাঠে সেই দেহ ঘিরে জড়ো হয়েছে ভিড়। বৃষ্টি উপেক্ষা করে। দেহ ছুঁয়ে, দেহকে ঘিরে সেই ভিড় সে দিন প্রতিজ্ঞা করেছিল: খুনিরা শাস্তি না-পাওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবেই। ঘোষণা হয়েছিল উচ্চগ্রামে, ‘প্রতিবাদীর মৃত্যু হয়, প্রতিবাদের নয়’।

Advertisement

কিন্তু, আন্দোলন চলল কি? সেই সময় থেকে ঘটনাপ্রবাহ যাঁরা দেখেছেন, একান্ত আলোচনায় তাঁরা বলেন, সেই ঝাঁঝ আর কোথায়! এবং স্বীকার করেন, বরুণের প্রতিবাদের তীব্রতার ধরনই ছিল আলাদা।

কে এই বরুণ বিশ্বাস? কী ভাবেই বা তিনি হয়ে উঠেছিলেন নির্যাতিত মহিলা, গরিবদের ভরসাস্থল? এই প্রশ্নের মুখে পড়ে এখনও জবাব হাতড়াতে স্থানীয় বাসিন্দারা কেউ চলে যান ২০০০ সালে, কেউ তারও আগে। সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ১৯৮০-র দশকের শেষ দিক থেকে এলাকায় দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য শুরু হয়, যার মাথা ছিল সুশান্ত চৌধুরী। সেই তাণ্ডব চলে নব্বইয়ের দশকেও। এরই মধ্যে এক বার পুলিশের তাড়া খেয়ে সুশান্ত গা ঢাকা দিয়েছিল শিলিগুড়িতে। কয়েক বছর পরে বাইরের কয়েক জন দুষ্কৃতী নিয়ে ফিরে আসে স্বমহিমায়। নিকটবর্তী নির্জন, জঙ্গুলে এলাকায় আস্তানা তৈরি করে সে। তার টাকাপয়সা, মদ-মোচ্ছবের টানে একে একে জড়ো হয় স্থানীয় যুবকেরা। দল বড় হয়। শুরু হয় ব্যবসায়ী ঠিকাদারদের কাছ থেকে তোলাবাজি এবং তাঁদের উপরে জুলুম।

২০০০ সালের ভয়াবহ বন্যার জল তখনও পুরোপুরি শুকিয়ে যায়নি। বন্যায় সর্বস্বান্ত মানুষেরা নতুন করে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করছেন সবে। ঠিক তখনই গাইঘাটার সুটিয়া এলাকার মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল ভয়ঙ্কর সেই সব দিন। সুশান্ত চৌধুরী ও তার দুষ্কৃতীবাহিনী লাগামহীন সন্ত্রাস শুরু করে। সুশান্ত, বীরেশ্বর ঢালি, রমেশ মজুমদার, রিপন বিশ্বাসের মতো দুষ্কৃতীদের কাছে সুটিয়া তখন অপরাধের মুক্তাঞ্চল।

স্থানীয়েরা এখনও সুশান্তদের তাণ্ডবের বিবরণ দিয়ে থাকেন। যেমন, ফ্লাড সেন্টার তৈরি হচ্ছিল যখন। সুশান্তেরা ঠিকাদারের কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। ঠিকাদার বিডিওকে জানালে পুলিশ নামমাত্র মামলা দিয়ে সুশান্তদের গ্রেফতার করে। কিছু দিনের মধ্যে তারা জামিন পেয়ে যায়। তার পরেই শুরু হয় গ্রামের মহিলাদের উপরে অকথ্য অত্যাচার। জোর করে বাড়িতে ঢুকে বা তাদের আস্তানা সুখ সাধুর ভিটেয় তুলে নিয়ে গিয়ে চলত নির্যাতন। গোবরডাঙা স্টেশন এলাকায় দুষ্কৃতীদের ‘ইনফর্মার’ থাকত। বাইরে থেকে কোনও মহিলা কাজ সেরে বাড়িতে ফিরলে দুষ্কৃতীরা তাঁদের নিশানা করত। বলদেঘাটা সেতু এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হত।

সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চটি তখনও তৈরি হয়নি। যিনি এখন সেই মঞ্চের সভাপতি, সেই ননীগোপাল পোদ্দার জানান, তাঁর ফুল খেতে একাধিক মহিলাকে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। প্রতিবাদ করলে কপালে জুটত বেধড়ক মার। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছিল যে, প্রতিবাদের সাহসই হারিয়ে ফেলছিলেন গ্রামের মানুষ।

তবে প্রকাশ্যে না হলেও, তলে তলে তত দিনে এগিয়ে এসেছেন ননীগোপাল পোদ্দার। সঙ্গে পেয়েছেন জীতেন বালা, হরিদাস মণ্ডল, হিতলাল বাইন, পূর্ণচন্দ্র মণ্ডলদের।

গোপনে জীতেনের বাড়িতে বসতেন তাঁরা। এক সঙ্গে কেউ বৈঠকে যেতেন না। তলে তলে জনমত তৈরি করতেও শুরু করেন। ননীগোপাল বলেন, ‘‘২০০২ সালে ফ্লাড সেন্টারের ঘটনায় সুশান্তদের পুলিশ গ্রেফতার করতেই আমরা আর দেরি করিনি। ওই বছর অগস্টে সুটিয়া বাজারে মাইক নিয়ে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে প্রচারে নামি আমরা। আমাদের প্রচারে লোকের মনেও সাহস বাড়তে থাকে।’’ তার পর? তিনি বলেন, ‘‘আমি মাইকে বলা শেষ করতেই কোথা এক যুবক এসে আমার হাত থেকে মাইক নিয়ে বলতে শুরু করেছিলেন। সেই যুবকেরই নাম বরুণ বিশ্বাস।’’

পরের দিন ননীগোপালেরা আটচালায় বৈঠক করে সুটিয়া প্রতিবাদী মঞ্চ তৈরি করেন। ননীগোপাল হন সম্পাদক। সভাপতি নীলরতন মজুমদার। বরুণও যুক্ত হন তাঁদের সঙ্গে। মানুষকে সংগঠিত করে ভয় ভাঙানোর কাজ শুরু করেন সকলেই। মঞ্চের পক্ষ থেকে বিডিও-এসডিও, স্থানীয় থানা, এসডিপিও-র কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। জেলাশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারের কাছেও যাওয়া হয়। ননীগোপাল বলেন, ‘‘তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আত্মীয় ছিলেন সিপিআই নেত্রী মালবিকা চট্টোপাধ্যায়। আমরা তাঁকে ঘটনার কথা জানাই। তাঁর মাধ্যমেই মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন।’’

এর পরেই রাজ্য প্রশাসন নড়েচড়ে বসে। পুলিশের আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুটিয়ায় আসেন তড়িঘড়ি। নির্যাতিতদের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁর নির্দেশে মামলা রুজু হতে থাকে।

প্রতিবাদী মঞ্চ সূত্রে জানা গিয়েছে, মোট ছ’টি গণধর্ষণের মামলা রুজু হয়। সঙ্গে তোলাবাজি, শারীরিক নির্যাতনের মামলা। অনেক নির্যাতিতা সম্মানের ভয়ে ধর্ষণের অভিযোগ করেননি। সব মিলিয়ে মোট ৩২টি মামলা হয় সুশান্তদের বিরুদ্ধে। ২০০২ সালে হওয়া প্রথম গণধর্ষণের মামলায় ২০০৩ সালে প্রথম সাজা ঘোষণা হয়। বিচার এবং তাতে যাবজ্জীবন হয় সুশান্ত-সহ ছ’জনের।

এই লড়াই করতে গিয়ে তত দিনে প্রচুর শত্রুও তৈরি করে ফেলেছেন প্রতিবাদীরা। বিশেষ করে বরুণ। এবং বাম আমলের রমরমার মধ্যেও কী ভাবে যেন তৃণমূলের কারও কারও সঙ্গে শত্রুতা তৈরি হয়েছে তাঁর। তার মধ্যে যে তৎকালীন স্থানীয় বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ছিলেন না, সেটা কে বলতে পারে! বরং ২০০৪ সালে লেখা বরুণের একটি চিঠিতে জ্যোতিপ্রিয়ের সম্পর্কে তিক্ততারই উল্লেখ রয়েছে। (চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement