জপমালার ঝোলায় রিভলভার, সেই পুরুত শঙ্কুরই শরণে শ্যামল

প্রফেসর শঙ্কু নন। পুরুত শঙ্কু! পরনে ধুতি আর গেরুয়া পাঞ্জাবি। হাল্কা দাড়ি। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে তিলক। ডান হাতটা সারা ক্ষণই জপমালার থলিতে ঢোকানো। মাঝারি উচ্চতার দোহারা চেহারার বছর পঞ্চাশের এই মানুষটিকে বামনগাছি এলাকার প্রায় সকলেই চিনতেন। তবে ওই জপের মালার থলিতে যে তুলসীমালার সঙ্গে সঙ্গে থাকত একটি রিভলভারও, সেটা জানতেন মাত্র হাতে গোনা কয়েক জনই!

Advertisement

অত্রি মিত্র ও অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৪ ০২:৫৮
Share:

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

প্রফেসর শঙ্কু নন। পুরুত শঙ্কু!

Advertisement

পরনে ধুতি আর গেরুয়া পাঞ্জাবি। হাল্কা দাড়ি। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল। গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। কপালে তিলক।

ডান হাতটা সারা ক্ষণই জপমালার থলিতে ঢোকানো। মাঝারি উচ্চতার দোহারা চেহারার বছর পঞ্চাশের এই মানুষটিকে বামনগাছি এলাকার প্রায় সকলেই চিনতেন।

Advertisement

তবে ওই জপের মালার থলিতে যে তুলসীমালার সঙ্গে সঙ্গে থাকত একটি রিভলভারও, সেটা জানতেন মাত্র হাতে গোনা কয়েক জনই!

শঙ্কু পুরুত নামে পরিচিত হলেও ভোটার পরিচয়পত্রে নাম তার শিশির মুখোপাধ্যায়। সাকিন: ৫৩/৬, চাউলপট্টি রোড, বেলেঘাটা।

এই মুহূর্তে রাজ্য পুলিশের ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকার অন্যতম নাম এই শঙ্কু পুরুত। কেন?

বামনগাছির প্রতিবাদী কলেজছাত্র সৌরভ চৌধুরীকে খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত শ্যামল কর্মকারকে আশ্রয় দিয়েছিল ওই শঙ্কুই। পুলিশ যখন হন্যে হয়ে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তখন তারাপীঠের হোটেলে শঙ্কু পুরুতের ভাড়া করা ঘরে দিব্যি আয়েশ করছে শ্যামল। পুলিশের চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য শঙ্কুই মন্দিরে উৎসর্গ করে দেয় শ্যামলের মাথার চুল।

শঙ্কু পুরুতের সঙ্গে শ্যামলের পরিচয় হল কী ভাবে?

জেরায় শ্যামল জানিয়েছে, শঙ্কু শুধু যজমানিই করে না। তৃণমূলের সক্রিয় কর্মী হিসেবেও বামনগাছি এবং বেলেঘাটায় তার নামডাক আছে। তৃণমূলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরেই শঙ্কুর কাছাকাছি আসে শ্যামল। প্রতি মাসে কয়েকটা দিন শঙ্কু থাকে বামনগাছির বাড়িতে। বাসিন্দারা জানান, তখন শঙ্কুর সঙ্গে সব সময়েই দেখা যেত শ্যামলকে। শঙ্কুর মাধ্যমেই শ্যামল এলাকার অনেক তৃণমূল নেতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।

বামনগাছিরা বাড়ি ছাড়াও শঙ্কু মাসের বেশির ভাগ দিন কাটায় বেলেঘাটায়। সেখানের সকলেই তাকে তৃণমূল নেতা জীবন সাহার ঘনিষ্ঠ বলে জানেন। বৃহস্পতিবার জীবনবাবু অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “ওকে আমি চিনিই না!” বেলেঘাটার ওই বাড়িতেও শ্যামলের নিয়মিত যাতায়াত ছিল বলে এলাকার বাসিন্দারা পুলিশকে জানিয়েছেন। তদন্তকারীরা জানান, সৌরভকে খুন করার পরেই শ্যামল যোগাযোগ করে শঙ্কু পুরুতের সঙ্গে। এলাকার এক রাজনৈতিক নেতার নির্দেশেই শঙ্কু তাকে আশ্রয় দেয় বলে খবর।

সৌরভ-হত্যায় মূল অভিযুক্ত শ্যামলের সঙ্গে তৃণমূল নেতাদের যোগসূত্র বেরিয়ে পড়ায় শাসক দলের নেতারা এখন এলাকায় অনেকটাই ‘ব্যাকফুট’-এ। বিষয়টা অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিতে তৃণমূলকর্মীরা এ দিনই বামনগাছিতে পোস্টার লাগাতে শুরু করেছেন। তাতে লেখা, ‘সৌরভ চৌধুরীর খুনি ও তাদের মদতদাতা সিপিএম-বিজেপি’র বিরুদ্ধে গর্জে উঠুন’। এমনিতেই এই পোস্টার নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে শ্যামলের আশ্রয়দাতা হিসেবে শঙ্কুর নাম উঠে এসেছে তদন্তে। অস্বস্তি বেড়েছে তৃণমূলের। এর মধ্যেই আজ, শুক্রবার এলাকায় জনসভা করে নিজেদের পায়ের তলার হারানো জমি উদ্ধারে নামছেন তৃণমূল নেতারা। তাগিদ এতটাই যে, মুকুল রায়-সহ শীর্ষ নেতারা যাচ্ছেন ওই সভায়।

সৌরভ-হত্যায় শঙ্কু পুরুতের নাম উঠে এল কী ভাবে?

তদন্তকারীরা জানান, খুনের পরে বামনগাছির ক্ষিপ্ত জনতা যে-সব সন্দেহভাজনকে মারধর করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল, তাদের জেরা করেই এই ঘটনায় শঙ্কুর যোগসূত্রের কথা জানতে পারে পুলিশ। ধৃতদের নিয়ে সোমবার ভোরেই বেলেঘাটায় শঙ্কুর বাড়িতে তল্লাশি-অভিযান চালায় পুলিশের একটি দল। পড়শিরা জানান, সোমবার ভোরে পুলিশের তিন-চারটি গাড়ি বাড়িটি ঘিরে ফেলে। বিপদ আঁচ করে তার আগেই অবশ্য গা-ঢাকা দিয়েছিল শঙ্কু। তাকে না-পেয়ে পড়শিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। এক পড়শি বলেন, “রবিবার থেকেই শঙ্কুর বাড়িতে তালা দেওয়া দেখেছি। ও সক্রিয় ভাবে তৃণমূল করে, জানতাম। বামনগাছিতে ওর বাড়ি আছে বলে ও জানিয়েছিল। কিন্তু শঙ্কু যে এমন একটা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে, তা বুঝতে পারিনি।”

অন্য এক প্রতিবেশী বলেন, “কয়েক জন যুবক মাঝেমধ্যেই শঙ্কুর বাড়িতে আসত। শনিবারেও কয়েক জন এসেছিল। রবিবার থেকে আমরা বাড়িতে তালা ঝুলতে দেখি।” পড়শিরা জানান, বেলেঘাটার বাড়িটি শঙ্কুর মামা বৈদ্যনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নামে। তিনি মারা গিয়েছেন। এখন বাড়িটির মালিক কার্যত শঙ্কুই।

শঙ্কুর বাড়ি আছে বামনগাছির কুলবেড়িয়া এলাকাতেও। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওটা আসলে তার শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু স্ত্রীকে মারধর করে তাঁর পরিবারের সকলকে তাড়িয়ে দিয়ে অন্য এক মহিলার সঙ্গে সেখানে সংসার পেতে জাঁকিয়ে বসেছিল শঙ্কু। প্রতি মাসে কয়েকটা দিন এসে বৌয়ের সঙ্গে কাটিয়ে যেত সে। মাঝেমধ্যে তাকে দেখা যেত তারাপীঠেও। সেই সূত্রে ওখানকার হোটেলগুলির সঙ্গে ভালই যোগাযোগ ছিল শঙ্কু পুরুতের।

তদন্তকারীরা জানান, সৌরভকে খুন করে শ্যামল শনিবার বেলেঘাটায় শঙ্কুর বাড়িতে যায়। পরিস্থিতি দেখে শঙ্কু সিদ্ধান্ত নেয়, ওই ঘটনার পরে শ্যামলকে নিয়ে ঘরে থাকা নিরাপদ নয়। শ্যামলকে নিয়ে শঙ্কু চলে যায় সুভাষ সরোবরে। সেখানে একটি বেঞ্চে রাত কাটায় দু’জনে। টাকার প্রয়োজন মেটাতে বামনগাছি থেকে ডেকে আনা হয় তোতাকে। তদন্তকারীর জেনেছেন, শঙ্কু যখন ফোন করে তোতাকে টাকা আনতে বলে, তখন সে সৌরভের বাড়িতে বসে তাঁর পরিবারকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। ফোন পেয়েই পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে তোতা যোগ দেয় শ্যামল-শঙ্কুর সঙ্গে।

রবিবার রাতে তারাপীঠে পৌঁছে পরের দিন, সোমবার তারা-মায়ের পুজো দেয় তিন জনেই। তার পরে তারা শঙ্কুর পরিচিত লজে যায়। সেখানে নিজের সচিত্র ভোটার পরিচয়পত্র জমা দিয়ে ঘর ভাড়া নেয় শঙ্কু। লজের খাতায় একটি মোবাইল নম্বরও লেখে। পুলিশ তদন্তে জেনেছে, ওই ফোন নম্বরটি আদৌ শঙ্কুর নয়। সেটি কর্মসূত্রে দিল্লিবাসী এক ব্যক্তির। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ তারা গৌড় এক্সপ্রেস ধরতে রামপুরহাট স্টেশনের দিকে রওনা দেয়। তদন্তকারীরা জানান, উত্তরবঙ্গে শঙ্কুর এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল শ্যামলদের। কিন্তু পুলিশ যে তাদের পিছু নিয়েছে, ওই সময়েই তার আঁচ পেয়ে যায় শঙ্কু। শ্যামলদের স্টেশনে রেখে ‘একটু ঘুরে আসছি’ বলে চম্পট দেয় সে।

শ্যামলদের গ্রেফতারের সময়েই শঙ্কুর এই ‘অন্তর্ধান’ নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন তুলেছেন বামনগাছির বাসিন্দাদের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ বলেই শঙ্কুকে ধরার ব্যাপারে গা-ছাড়া মনোভাব দেখিয়েছে পুলিশ। সেই সুযোগেই পালিয়েছে শঙ্কু। যদিও উত্তর ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার তন্ময় রায়চৌধুরী এ দিন বলেন, “আমরা শঙ্কুকে ধরার জন্য সব রকম চেষ্টা চালাচ্ছি।”

সৌরভের হত্যাকাণ্ডে দোষীদের দ্রুত শাস্তির দাবিতে এ দিন একটি নতুন মঞ্চও তৈরি হয়েছে। মঞ্চটির নাম, ‘আমরা আক্রান্ত’। এই মঞ্চে রয়েছেন কামদুনি, সুটিয়া, পাড়ুই কাণ্ডে আক্রান্ত-সহ অম্বিকেশ মহাপাত্র, ধনেখালির কাজী নাসিরুদ্দিন, বালির তপন দত্তের স্ত্রী প্রতিমা দত্তেরাও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement