ব্যারাকপুরে দুষ্কৃতীদের গুলিতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর পুত্রের মৃত্যুর ঘটনায় সরগরম রাজ্য রাজনীতি। গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
ডাকাতিতে বাধা দেওয়ায় ব্যারাকপুরে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর পুত্রকে গুলি করে খুনের ঘটনায় শোরগোল পড়ে গিয়েছে রাজ্যে। বুধবার সন্ধ্যায় ব্যারাকপুরের আনন্দপুরী এলাকায় একটি সোনার দোকানে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে। দুষ্কৃতীদের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে দোকানের মালিকের পুত্র নীলাদ্রি সিংহের (২৯)। দোকানে ঢুকে লুটপাটের সময় বাধা দেন নীলাদ্রি। আর তখনই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় দুষ্কৃতীরা। প্রতিবাদী যুবকের হত্যার ঘটনায় তোলপাড় রাজ্য রাজনীতি। দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য নিয়ে পুলিশের ভূমিকায় ক্ষোভপ্রকাশ করলেন বাংলার শাসকদলেরই নেতা অর্জুন সিংহ। তৃণমূল নেতা অর্জুনের মন্তব্য রাজ্য রাজনীতিতে হইচই ফেলে দিয়েছে। পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন তোলে বিরোধীরা। পুলিশমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বার বারই সরব হতে দেখা গিয়েছে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীকে। এ বার তৃণমূলের অর্জুন যে ভাবে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে রুষ্ট হলেন, তা এই পর্বে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে।
ব্যারাকপুর অর্জুনের এলাকা। এর আগেও বহু বার উত্তর ২৪ পরগনার ওই শহরে দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্যের ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। এ বার সে শহরে গুলি চালানোর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন অর্জুন। অন্য দিকে, গুলি চালানোর ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। ব্যারাকপুরের ঘটনার পর অর্জুন পুলিশ প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘৪০ কেজির ভুঁড়ি নিয়ে হাঁটতেই পারে না। সে আবার অপরাধীদের ধরতে পারে নাকি!’’ তাঁর এই মন্তব্যের বিরুদ্ধে সরব হয়েছে তৃণমূল। অর্জুনের কণ্ঠে ‘বিরোধী স্বর’ ধরা পড়েছে বলে পাল্টা সরব হয়েছেন তৃণমূল মুখপাত্র কুণাল ঘোষ। তবে তাঁর প্রতি দলের মনোভাব নিয়ে অর্জুন যে একেবারেই বিচলিত নন, তা তাঁর কথাতেই ধরা পড়েছে। বলেছেন, ‘‘ভুল তো কিছু বলিনি। যা বাস্তব সেটাই তো বলেছি।’’
বুধ-সন্ধ্যায় কী হয়েছিল?
ব্যারাকপুর স্টেশনের কাছে আনন্দপুরীর ওল্ড ক্যালকাটা রোডে একটি সোনার দোকান রয়েছে। ওই দোকানেই বুধবার সন্ধ্যায় গুলি চলে। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন দোকানের মালিক-সহ ৩ জন। মৃত্যু হয়েছে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর পুত্র নীলাদ্রি সিংহের (২৯)। পুলিশ সূত্রে খবর, ৩-৪ জন দুষ্কৃতী বাইকে করে দোকানে আসেন। গয়না দেখার নাম করে তাঁরা লুটপাঠ শুরু করেন। বাধা দিলে গুলি চালান দুষ্কৃতীরা। ব্যারাকপুরের পুরপ্রধান উত্তম দাস জানান, হামলার সময় দোকানে ৪ জন ছিলেন। মালিক, মালিকের পুত্র এবং ২ কর্মচারী দোকানে থাকাকালীন পিস্তল হাতে দরজা ঠেলে ঢোকেন দুষ্কৃতীরা। যা আছে, বার করে দিতে বলা হয় তাঁদের। মালিকের পুত্র নীলাদ্রি সামনে এগিয়ে এসে বাধা দিলে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। পর পর কয়েক রাউন্ড গুলি চালান দুষ্কৃতীরা। মালিক এবং এক কর্মী জখম হন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। খবর পেয়েই ঘটনাস্থলে পৌঁছয় টিটাগড় থানার পুলিশ।
প্রতিবাদ করতে গিয়েই মৃত্যু
হঠাৎ করে যে এমন একটা ঝড় আসবে, তা বোধহয় কল্পনাও করেনি সিংহ পরিবার। গত ৮ ডিসেম্বর ব্যারাকপুরের বড়পোল এলাকার বাসিন্দা ঐন্দ্রিলা মান্নার সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল নীলাদ্রির। বিয়ের পর বৃহস্পতিবার ছিল তাঁদের প্রথম জামাইষষ্ঠী। কিন্তু আগের সন্ধ্যাতেই তাঁদের সুখী দাম্পত্য ভেঙে গেল। বিয়ের ৬ মাসের মাথায় স্বামীকে হারিয়ে শোকে পাথর ঐন্দ্রিলা। বিয়ের আগে তাঁদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ২০১৪ সালে ব্যারাকপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন নীলাদ্রি। পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ভূগোল অনার্স নিয়ে পড়েন। ছোটবেলায় ছবি আঁকা শিখেছিলেন নীলাদ্রি। গয়নার নকশাও তৈরি করতেন তিনি। স্বভাবে শান্তশিষ্ট হলেও নীলাদ্রির মধ্যে প্রতিবাদী সত্তা ছিল বলে জানিয়েছেন তাঁর এক বন্ধু। বুধবার সন্ধ্যায় যখন দোকানে দুষ্কৃতীরা ঢুকে লুটপাঠ শুরু করেছেন, তখন সেই শান্ত ছেলেই বাধা দিতে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তার পর দুষ্কৃতীদের গুলি সেই তরতাজা শিল্পীর প্রাণ কেড়ে নিল।
ক্ষুব্ধ তৃণমূলের অর্জুন
ব্যারাকপুরের ‘বেতাজ বাদশা’ নামে পরিচিত অর্জুন সিংহ। একদা তৃণমূলের দাপুটে নেতা ছিলেন অর্জুন। পরে বিজেপিতে যোগ দেন। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে জিতে সাংসদ হন অর্জুন। এর পরে আবার তৃণমূলে প্রত্যাবর্তন ঘটে তাঁর। বর্তমানে খাতায় কলমে বিজেপির সাংসদ অর্জুন। কিন্তু তৃণমূলের নেতা। ব্যারাকপুরে সোনার দোকানে গুলি চালানোর ঘটনায় পুলিশ-প্রশাসনের ভূমিকায় ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন বাংলার শাসকদলেরই নেতা অর্জুন। কাঠগড়ায় তুলেছেন ব্যারাকপুর পুলিশকে। বৃহস্পতিবার ব্যারাকপুরের সাংসদ বলেন, ‘‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, পুলিশের ভূমিকা সঠিক নয়। পুলিশ-প্রশাসনের উপর মানুষের যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে, তাতে আমাদের দলের ক্ষতি হবে।’’ বর্তমান পুলিশ আধিকারিকরা অপরাধীদের ধরতে ব্যর্থ বলেও তোপ দাগেন তিনি। শুধু তাই নয়, রাজ্যের পুলিশ কর্মীদের চেহারার গড়ন নিয়েও কটাক্ষ করেছেন অর্জুন। বলেছেন, ‘‘৪০ কেজির ভুঁড়ি নিয়ে হাঁটতেই পারে না। সে আবার অপরাধীদের ধরতে পারে নাকি!’’
তৃণমূল বনাম অর্জুন
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীই পুলিশমন্ত্রী। অর্জুন তৃণমূলের নেতা। অথচ, সেই তিনিই রাজ্যের পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। দলের নেতার এ হেন মন্তব্য একেবারেই ভাল চোখে দেখেননি তৃণমূল নেতৃত্ব। তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, ‘‘কোনও কোনও অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটছে এটা ঠিক। তাকে সমর্থন করা যায় না। একই সঙ্গে দলের একজন প্রবীণ নেতা হিসাবে অর্জুন সিংহেরও বিরোধীদের সুরে মন্তব্য করা ঠিক নয়।’’ এর পাল্টা মুখ খুলেছেন অর্জুনও। বৃহস্পতিবার আনন্দবাজার অনলাইনকে সাংসদ বলেন, ‘‘দল কিছু ভাবতে পারে। কিন্তু আমাকে তো মানুষ নির্বাচিত করেছে! আমায় তো মানুষের কথা বলতে হবে। তাদের নিয়েই চলতে হবে। আর ভুল তো কিছু বলিনি। যা বাস্তব সেটাই তো বলেছি।’’
কী বলছে বিজেপি
অর্জুন এখন বিজেপির কেউ নন। তবে ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পদ্ম প্রতীকে লড়েই সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। ‘দলবদলু’ অর্জুনের মন্তব্যকে গুরুত্ব দিচ্ছে না রাজ্য বিজেপি। বঙ্গ বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘‘তিনি বিজেপিতে এসে তৃণমূলের কাছে গদ্দার হয়েছিলেন। বিজেপি সাংসদ হয়ে তৃণমূলে গিয়ে গদাধর হয়েছেন। ওঁর কথার কোনও রাজনৈতিক গুরুত্বই নেই।’’