নবনীতা দেবসেন।
নবনীতা চলে গেল, এ কথা ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে। ওর সঙ্গে পঞ্চাশ বছরের কাছাকাছি পরিচয়। ঘনিষ্ঠতাও যথেষ্ট। আমাদের বাড়িতেও এসেছে। নবনীতা দেবসেন তো শুধু এক জন ব্যক্তি নয়, প্রতিষ্ঠানও বটে। কবিতা-গল্প-উপন্যাস তো বটেই, ও ছোটদের জন্যও গল্প লিখেছে প্রচুর।অনেকেই জানেন না, ও অসাধারণ রূপকথা লিখতে পারত। আমি ওর রূপকথার বই পড়েছি এবং মুগ্ধ হয়েছি।
অসম্ভব রসজ্ঞান ছিল ওর।নিজেকে নিয়ে রসিকতা করত। এরই পাশাপাশি নবনীতা সংস্কারমুক্তও ছিল। সারা পৃথিবী ও যে কত বার করে ঘুরেছে, তার ঠিক নেই। দুরারোগ্য রোগে ভুগছে জেনেও এখানে ওখানে চলে যেত। আসলে ও অকুতোভয় মেয়ে। হাঁটতে খুব অসুবিধা হত। লাঠি নিয়ে ঘুরত। কিন্তু শরীর নিয়ে ওর আলাদা কোনও ‘আহা উহু’ ছিল না। কোনও অভিযোগও করত না। ওর মানসিকতা, রুচি, তীব্র জেদ— সব দিক দিয়েই ওকে ভাল লাগত আমার। ওর কথা বলে শেষ হবে না।
ও পাশে বসলে এক এক সময় মনে হত যেন ডায়ানামোর পাশে বসে আছি! এমনই ওর প্রাণশক্তি। প্রচণ্ড কথা বলত। কোনওআজেবাজে কথা নয়,আসলে ওর কথা শুনতে আমি ভালবাসতাম। ও যেমন হাসত, হাসাতেও পারত।
আরও পড়ুন- ৮১ বছরে প্রয়াত সাহিত্যিক নবনীতা দেবসেন, শোকস্তব্ধ সাহিত্য জগৎ
আমি মাঝে মাঝে রসিকতা করে বলতাম, নবনীতা হল এমন এক জন মানুষ যার পুরো পরিবারই বিখ্যাত! বাবা বিখ্যাত, মা বিখ্যাত, স্বামী বিখ্যাত, মেয়েরাও খ্যাতিমান। এক অদ্ভুত ধরনের খ্যাতিমান পরিবার, যে পরিবারের সকলেই বিখ্যাত। ওরা যার যার নিজের ক্ষেত্রে বিখ্যাত।
ও দীর্ঘ দিন হাঁপানিতে ভুগেছে। ইনহেলার নিয়ে ঘুরত। অথচ শরীর নিয়ে কিছু জিগ্যেসকরলে হয়তো বা বিরক্ত হত, বলত, ও কিছু না।আসলে, শারীরিক কোনও সমস্যাকেই ও বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাইত না। এই যেমন,আলাস্কার মতো জায়গায় নবনীতার মতো হাঁপানি রোগী চলে গেল। ঘুরেও এল। ও একাধিকবার আলাস্কায় গিয়েছে।
ওর এই চলে যাওয়াটা অপূরণীয় ক্ষতি। ওকে নিয়ে আলাদা কোনও আদিখ্যেতা ছিল না, কিন্তু শ্রদ্ধা করতাম। নবনীতা এক বর্ণময় চরিত্র। নবনীতার কলমটা থেমে গেল। আরও কিছু দিন ওর কলম চলতে পারত। এই চলে যাওয়া ব্যক্তিগত ক্ষতি এবং বাংলা সাহিত্যের পাঠক হিসেবেও এক অপূরণীয় ক্ষতি বলে মনে করি।