Bangladesh Unrest

‘হাসিনা স্বেচ্ছাচারী, কিন্তু মুজিবের মূর্তি চুরমার কেন?’ ভাষাশহিদের পরিবার চায় শান্তি ফিরুক

সফিউর জন্মেছিলেন কোন্নগরে। পড়াশোনা কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে। তার পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর্বেই সফিউরের বাবা পরিবার নিয়ে চলে যান ঢাকায়।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

কোন্নগর শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২৪ ১৬:৫৩
Share:

সফিউরের ছবি হাতে ভাই আহসানুর রহমান এবং বোন সেতারা খাতুন। —নিজস্ব চিত্র।

নোনাধরা দেওয়ালের গায়ে অনেক ইতিহাস। তাতে জুড়ে আছে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। জুড়ে আছেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ত্রৈলোক্যনাথ মিত্র। ৩০০ বছরের পুরনো বাড়িটির গায়ে জংলা ছাপ গাঢ় হয়েছে। অভাবে অযত্নের ছাপও স্পষ্ট। গঙ্গাপারের সেই বাড়িটিতেই যত্নে রাখা রয়েছে সফিউর রহমানের ছবি। যে সফিউর ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি উর্দু আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাংলা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন ঢাকার রাজপথে।

Advertisement

যে ১৪ জন সে দিন শহিদ হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে হুগলির কোন্নগরের সফিউর অন্যতম। তাঁরই ছবি আঁকড়ে থাকেন তাঁর খুড়তুতো ভাই আহসানুর রহমান এবং বোন সেতারা খাতুন। শহিদ সফিউরের ছবি হাতে নিয়েই বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগপ্রকাশ করছেন তাঁরা। তাঁদের বক্তব্য, শেখ হাসিনা যে ভাবে সরকার চালিয়েছেন, তাতে তাঁর রাজনৈতিক শাস্তি প্রাপ্যই ছিল। কিন্তু একই সঙ্গে প্রশ্ন তুলছেন, কেন ভাঙা হল বঙ্গবন্ধুর মূর্তি? কেন ঘা পড়ল ভাষা শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভে? কেন মলিন করে দেওয়া হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস?

কোন্নগরে সেই জরাজীর্ণ বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

সফিউর জন্মেছিলেন কোন্নগরেই। পড়াশোনা কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয়ে। তার পরে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়া। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হয়েছিল ভারত। দেশভাগের সেই পর্বেই সফিউরের বাবা মাহবুবর রহমান পরিবার নিয়ে চলে যান ঢাকায়। তিনি ছিলেন বিচারক। ঢাকা হাই কোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত ছিলেন। খুড়তুতো ভাই আহসানুর জানান, ‘‘জেঠু চেষ্টা করেছিলেন দাদাকে বিদেশে ডাক্তারির ডিগ্রি নিতে পাঠাতে। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের এমবিবিএস ডিগ্রিকে স্বীকৃতি দেয়নি। ফের তাঁকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পড়তে হয়েছিল।’’

Advertisement

বাংলাদেশ ছেড়ে হাসিনার পালিয়ে যাওয়া, তার পরবর্তী সময়ে লাগাতার হিংসা প্রসঙ্গে সফিউরের ভাই আহসানুর বলেন, ‘‘জানি, হাসিনা স্বেচ্ছাচার চালিয়েছেন। জানি, মানুষের কোনও গণতান্ত্রিক অধিকার ছিল না। কিন্তু তাই বলে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙা হবে? মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে দিতে চাইছে কারা? কারা ভাষা শহিদদের অসম্মান করছে?’’ গঙ্গার একেবারে পাশেই রহমানদের বাড়ি। সেই বাড়ির দাওয়ায় বসে আহসানুরেরা চান পদ্মাপারে শান্তি ফিরুক। তাঁর কথায়, ‘‘দেখে মনে হচ্ছে, ওই আন্দোলনে মৌলবাদীরা ঢুকে পড়েছে। সেটাই সবচেয়ে ভয়ের।’’ হাসিনার দেশত্যাগের পর থেকে বাংলাদেশে যা চলছে, তা ‘গণতান্ত্রিক’ বলে মানতে রাজি নন আহসানুর। তাঁর কথায়, ‘‘মুক্তিযুদ্ধকে বাদ দিয়ে কখনও বাংলাদেশের কথা ভাবা যায় না! একটা অংশ ইতিহাস মুছতে চাইছে। আশা করি, বাংলাদেশ এই অশুভ সময় কাটিয়ে উঠবে।’’

শরিকি ঝঞ্ঝাটে বাড়িটির সংস্কার হয় না। প্রতি বার ২১ ফেব্রুয়ারি এই বাড়িতে আসেন স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের লোকজন। তার পর আবার দেওয়াল বেয়ে ওঠে গুল্মলতা। তাঁদের পরিবারের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য বোঝাতে গিয়ে আহসানুর বলছিলেন, কোন্নগরের বিশিষ্ট পণ্ডিত ত্রৈলোক্যনাথ মিত্রের বাড়ির দুর্গাপুজোয় পঞ্চমীর দিন কর্তা হয়ে যেতেন রহমান পরিবারের লোকজন। অদূরেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাগানবাড়ি। সে জমিও এককালে ছিল রহমান পরিবারের হাতে। শরিকি ঝামেলায় কিছু বদলায়নি। এখনও এই জীর্ণ বাড়িতে বিদ্যুতের বিল আসে শহিদ সফিউরের বাবা মাহবুবর রহমানের নামে। ৬ বিঘা ১ কাঠা ১০ ছটাক জায়গা রহমান পরিবারের। সেখানেই পারিবারিক মসজিদ। গোরস্থানও। যে বাড়ির দিকে নজর পড়েছিল অনেক প্রোমোটারের। তবে ভাষা শহিদের স্মৃতিই এই ভিটে ইমারত কারবারিদের গ্রাস থেকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে। পেশায় শ্রীরামপুর কোর্টের মুহুরি আহসানুরের সংসারে অভাব রয়েছে। শরিকদের সঙ্গে মামলা লড়তে লড়তে সর্বস্ব খুইয়েছেন। তা-ও ঐতিহ্যের ভিটে বিকিয়ে যেতে দেননি। সেই ভিটেতে বসেই ভাষা শহিদের ভাই বলছেন, ‘‘বাংলাদেশের ঐতিহ্য আর চেতনাকে যারা গ্রাস করতে চাইছে, সেই শক্তি পরাস্ত হোক। আবার মাথা তুলুক বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement