প্রদ্যুৎ ঘোষ
বেশ কয়েক দিন ধরেই মাথার চুল পড়ছে। হাতের চামড়াতেও দেখা দিয়েছে একটা অদ্ভুত পরিবর্তন। গা বমি বমি ভাব। চিকিৎসকের কাছে যেতে দেখা গেল, গণ্ডগোলের মূল কারণ আর্সেনিক দূষণ।
বাতাসে প্রতি দিন বাড়ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা। হাঁপানির রোগে আজকাল অনেকেই অসুস্থ।
কী ভাবে রেহাই মিলতে পারে এই সমস্যাগুলি থেকে?
ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব কালটিভেশন অব সায়েন্সের গবেষক প্রদ্যুৎ ঘোষ সেই পথ খুঁজতেই গবেষণা করছেন। বিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে তিনি বলেছেন, ‘অ্যানায়ন রেকগনিশন’। এ নিয়ে তাঁর গবেষণাই এ বছর তাঁকে এনে দিল ‘শান্তি স্বরূপ ভাটনগর’ পুরস্কার। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক আজ সাতটি বিভাগে এই পুরস্কার ঘোষণা করেছে।
কী এই ‘অ্যানায়ন রেকগনিশন’?
যে কোনও যৌগের দু’টি অংশ। যার একটিতে থাকে ধনাত্মক আধান বা পজিটিভ চার্জ। এটিকে বলে ক্যাটায়ন। অপরটিতে থাকে ঋণাত্মক আধান বা নেগেটিভ চার্জ। রসায়নের ভাষায় এটি অ্যানায়ন। জলে আর্সেনিক থাকে এই অ্যানায়ন হিসেবেই, যার নাম আর্সেনেট। তেজষ্ক্রিয় বর্জ্যতে থাকে সালফেট। এই আর্সেনেট, সালফেট কিংবা ফ্লোরাইডের মতো ক্ষতিকর অ্যানায়নগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করাই লক্ষ্য প্রদ্যুৎবাবুর। তাঁর কথায়, ‘‘ক্যাটায়ন নিয়ে অনেক কাজই হয়। অ্যানায়ন নিয়ে কাজ হয় কম। এই অ্যানায়নগুলির দিকে নজর না দিলে বিপদ। ঠিক যেমন, সমাজের অর্ধেক অংশ নারীরা। তাঁরা উপেক্ষিত হলে সমাজের সাম্যাবস্থাই নষ্ট হবে।’’ প্রদ্যুৎবাবুর বক্তব্য, অনেক অ্যানায়নই স্বভাবে তেমন শিষ্ট নয়। যেমন জলের আর্সেনেট। যার ফলে ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। আর এক অ্যানায়ন, সালফেট। যার কারণে জলে খরতা বাড়ে। কাপড় কাচতে বেশি সাবান লাগে। তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য পরিশোধনের সময়েও সমস্যা হয় এই সালফেটকে নিয়ে। বেশি তাপমাত্রায় এর কারণে বন্ধ হয়ে যেতে পারে পরিশোধন। এই ‘দুষ্ট’ অ্যানায়নদের নিয়েই প্রদ্যুৎবাবুর গবেষণা। তবে তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ‘‘কেউ যদি ভাবেন এই গবেষণার সাহায্যে কালই আর্সেনিক দূষণ রোধ করা যাবে, সেটা বড় ভুল হবে।’’ তাঁর মতে, এই গবেষণা আসলে ওই বৃহত্তর লক্ষ্যে পৌঁছনোর প্রথম পদক্ষেপ।
প্রদ্যুৎবাবু জানিয়েছেন, ওই সালফেটকে দূর করার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তাঁরা। যে ট্র্যাপিং এজেন্ট বা রাসায়নিকের সাহায্যে সালফেট বা আর্সেনেটকে সরানো হয়, তা-ই বানানো হয় প্রদ্যুৎবাবুর গবেষণাগারে। ওই ট্র্যাপিং এজেন্টের সাহায্যে ওই অ্যানায়নগুলোকে একটা মোড়কে পুরে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়। আর তার পর তরল থেকে সেগুলি সরিয়ে ফেলা সহজ হয়।
বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে অভাবনীয় কাজের স্বীকৃতি হিসেবেই প্রতি বছর দেওয়া হয় শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার। এ বছর জীববি়জ্ঞানে পুরস্কার পেয়েছেন আইআইএসসি বেঙ্গালুরুর বালাসুব্রহ্মণ্যন গোপাল। রসায়নে প্রদ্যুৎবাবু ও পুণের ডি শ্রীনিবাস রেড্ডি। আইআইটি কানপুরের জ্যোতিরঞ্জন শ্রীচন্দন রায় পেয়েছেন পৃথিবী, আবহাওয়া, সমুদ্র এবং গ্রহবিজ্ঞান বিভাগে। ইঞ্জিনিয়ারিং এবং চিকিৎসা, এই বিভাগ দু’টিতে যথাক্রমে পেয়েছেন আইআইটি কানপুরের যোগেশ মোরেশ্বর জোশী এবং মুম্বই টিআইএফআর-এর বিদীতা অশোক বৈদ্য। পদার্থবিজ্ঞানে যৌথ ভাবে রয়েছেন ভুবনেশ্বরের বেদঙ্গদাস মোহান্তি এবং টিআইএফআর-এর মন্দার মধুকর দেশমুখ। আর অঙ্কে রয়েছেন টিআইএফআর-এর ঋতব্রত মুন্সি ও কে সন্দীপ।
কিন্তু এগারো জনের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গের মাত্র এক জন বিজ্ঞানী কেন? তা হলে কি এখানকার গবেষণাগারে সেই পরিকাঠামো নেই, যা সহজেই মিলছে বেঙ্গালুরু কিংবা মুম্বইয়ে? এ যুক্তি অবশ্য মানতে নারাজ প্রদ্যুৎবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘আসলে আইআইএসসি দেখুন বা আইআইটি, ওখানে অনেক ধরনের বিভাগ। অধ্যাপকদের সংখ্যাও প্রচুর। আমাদের প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপকের সংখ্যা মাত্র ৬৯। আর ওখানে ৪০০!’’
প্রদ্যুৎবাবুর কথায়, সেই ৬৯ জন অধ্যাপক নিয়ে তাঁরা লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছেন। তাঁর মতে, আজকাল গবেষণার জন্য প্রথম সারির ছাত্ররা কলকাতা ছেড়ে মোটেই যাচ্ছেন না। তাঁদের কাছেই আসছেন ভব্যিষৎ গড়তে। আর আগামীর গবেষকদের নিয়ে তাই যথেষ্ট প্রত্যয়ী একদা আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজের এই ছাত্র প্রদ্যুৎ ঘোষ। উচ্চ কণ্ঠে তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা এগিয়ে যাব। যাবই।’’