বানচাল ভূত বিক্রি, ক্রেতাও পগারপার

ভূতের দাম উঠেছিল দশ লক্ষ টাকা। কিন্তু ভূত নিজের ভিটে ছেড়ে পরের বাড়ি যেতে রাজি হয়নি। তাই নিয়ে বিস্তর গোলযোগ। শেষ অবধি ভূত-পেত্নী নিয়ে বেআইনি বেসাতির বিহিত করতে মাঠে নামতে হল কলকাতা পুলিশকে। এ ভূত যে-সে ভূত নয়। শহরের মানুষ হয়তো ভূত বলতে বেম্মদত্যি-মামদো-লুল্লু-ঘ্যাঁঘোদের কথাই ভাবেন। কিন্তু গ্রামে-গ্রামান্তরে কত বিচিত্র কিসিমের ভূতের বাস, তার খবর ক’জন রাখেন! ধনকুদরা তেমনই কাব্যে উপেক্ষিত এক ভূত। নিবাস পুরুলিয়া। মানবপ্রেমিক বলে ধনকুদরার সেখানে বিশেষ খ্যাতি আছে।

Advertisement

শিবাজী দে সরকার ও শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৪ ০২:৪৯
Share:

অঙ্কন: সুমিত্র বসাক

ভূতের দাম উঠেছিল দশ লক্ষ টাকা। কিন্তু ভূত নিজের ভিটে ছেড়ে পরের বাড়ি যেতে রাজি হয়নি। তাই নিয়ে বিস্তর গোলযোগ। শেষ অবধি ভূত-পেত্নী নিয়ে বেআইনি বেসাতির বিহিত করতে মাঠে নামতে হল কলকাতা পুলিশকে।

Advertisement

এ ভূত যে-সে ভূত নয়। শহরের মানুষ হয়তো ভূত বলতে বেম্মদত্যি-মামদো-লুল্লু-ঘ্যাঁঘোদের কথাই ভাবেন। কিন্তু গ্রামে-গ্রামান্তরে কত বিচিত্র কিসিমের ভূতের বাস, তার খবর ক’জন রাখেন! ধনকুদরা তেমনই কাব্যে উপেক্ষিত এক ভূত। নিবাস পুরুলিয়া। মানবপ্রেমিক বলে ধনকুদরার সেখানে বিশেষ খ্যাতি আছে।

পুরুলিয়ার লোকায়ত বিশ্বাস বলে, ধনকুদরা গ্রামের লোকের ফসল, গরু-ছাগল সব কিছুই রক্ষা করেন। নৃতত্ত্ববিদ পশুপতিপ্রসাদ মাহাতোরও অভিজ্ঞতা, কাঁসাই নদীর ধারে তাঁর ছোটবেলার ডাবর গ্রামে ধনকুদরা-কুদরা-পাঁচবোহনী-সাতবোহনীর মতো ভূতেদের উপরে অচলা আস্থা ছিল মানুষের। মরাইয়ে ধান রাখার পরে ধনকুদরার স্মরণে সিঁদুরের দাগ কাটা হতো।

Advertisement

রঘুনাথপুরের মহারাজনগর গ্রামের লখু হেমব্রমের বাড়িতে এমনই এক ধনকুদরার আবাস। আর সেই খবরটি কানে এসেছিল ঠাকুরপুকুরের বাসিন্দা প্রসেনজিৎ মণ্ডলের। ব্যস! প্রসেনজিৎ ঠিক করে ফেলেন, ধনকুদরা তাঁর চাই-ই চাই। প্রসেনজিৎ কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্পের ‘সুরেন্দ্র’ নন, যে ভূতে বিশ্বাস তাড়াতেই ভূত ধরে দেখাতে বলেছিল। প্রসেনজিতের কাছে ভূত মানে সাফল্যের জিন! তাঁর ধারণা, ধনকুদরাকে পেলেই ধনদৌলতের বান ডাকবে। ভূতের বর পেয়ে গুপির গানের গলা খুলেছিল, গোঁসাইবাগানের ভূতকে পেয়ে বুরুন অঙ্কে তেরো-র গেরো কাটিয়েছিল এই সব পাথুরে প্রমাণ প্রসেনজিতের মাথায় জাঁকিয়ে বসেছিল কি না জানা যায়নি! তবে পুলিশ জানতে পেরেছে, সে মোটেও অত সাদাসিধে, নিষ্পাপ নয়। এর আগেও চটজলদি বড়লোক হওয়ার চেষ্টায় প্রসেনজিৎ লোক ঠকানোর কারবার ফেঁদেছিল।

এ যাত্রা প্রসেনজিৎ আর লখুর মধ্যে যোগাযোগের কাজটি করছিলেন দিলীপ মণ্ডল নামে এক ব্যক্তি। ভূত-ব্যবসার বিশ্বস্ত দালাল বলে নিজেকে দাবি করছিলেন তিনি। দিলীপের মাধ্যমেই লখু জানতে পারেন, কলকাতার এক বাবু ধনকুদরাকে কিনতে মরিয়া! দিলীপের মাধ্যমেই লখুর বাড়ির মাটি নিয়ে গিয়ে পরীক্ষা করান প্রসেনজিৎ-রা। তান্ত্রিকের মাটি-পরীক্ষায় ধরা পড়ে, লখুর ভিটেয় সত্যি ভূতের বাস। প্রসেনজিৎ একেবারে দশ লক্ষ টাকা দর দিতে রাজি হয়ে যান।

লখু হেমব্রমের বয়স বছর সত্তর। শক্ত-সমথর্র্ চেহারা। এখনও নিজের দু’বিঘে জমি চাষ করেন। গ্রামের বাড়িতে বসেই বলছিলেন, বছর ছ-সাত আগে ধনকুদরার পুজো শুরু করার পরেই চাষবাসে উন্নতি। সেই লক্ষ্মীমন্ত ভূতকে বেচার কোনও ইচ্ছেই তাঁর ছিল না বলে লখুর দাবি। তবে এটাও ঘটনা যে, দিলীপ, প্রসেনজিতের জোরাজুরিতেই হোক বা এক লপ্তে দশ লাখ টাকার মোহে সাময়িক ভাবে ভূতের মায়া কাটিয়েই হোক, লখু ভূত বেচতে রাজি হয়েছিলেন। গ্রামবাসীদের দাবি, এমন ঘটনা প্রথম নয়। ধনকুদরা বা অন্য ভূত কিনতে মাঝেমধ্যেই শহর থেকে কিছু লোকের উদয় হয়। গ্রামের অনেকে টাকার টোপ গিলেও ফেলেন। এ বারও সেটাই ঘটল।

পরের দৃশ্য, কলকাতা। আনুষ্ঠানিক ভাবে ভূত সম্প্রদান করতে জীবনে প্রথম বার কলকাতা এলেন সপরিবার লখু। পড়শিদের কয়েক জনকেও সঙ্গে করে আনলেন। রীতিমতো ঢাউস গাড়িতে চাপিয়ে খাতির করে কলকাতায় আনা হল তাঁদের। শিয়ালদহের একটি হোটেলে তাঁদের রাখা হল। ভূত-যজ্ঞে ভিড়ে গেলেন হোটেলের মালিক-কাম-ম্যানেজার জয়ন্ত সাহাও।

হোটেলের ঘরে চালে তেল-সিঁদুর লেপে পুবমুখো হয়ে বসে ভূত-আবাহন শুরু করেন লখু। প্রসেনজিৎ এক তান্ত্রিককেও মজুত রেখেছিলেন। বলা যায় না, আবির্ভাবের পরে ধনকুদরা যদি ভূতের নৃত্য জোড়েন, তাঁকে সামলানোর লোক চাই! কিন্তু সব আয়োজন বৃথা! দিনের পর দিন ডাকাডাকি করেও ভূত দর্শন দিলেন না। প্রসেনজিৎও নাছোড়! ভূত নামাতেই হবে! লখু অসহায় ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ভূত তো হাওয়ার মতো! তিনি এসেছেন টের পাওয়া যায়! কিন্তু চোখে দেখা যায় না! প্রসেনজিতের দাবি, ভূতের হাওয়াই বা বইছে কই! হাওয়া দিলে তবেই তো তাকে বোতলবন্দি করা যাবে! দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে করতে এক দিন ধৈর্যের বাঁধ ভাঙে প্রসেনজিতের। তাই তাঁর বেশ কিছু টাকা খরচও হয়ে যায়। অভিযোগ, এ বার তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন। ভূত না পেলে লখুদের প্রাণে মারারও হুমকি দেন। তবে লখু পুলিশকে জানিয়েছেন, প্রসেনজিৎ তাঁদের কিডনি কেটে বেচে দেবেন বলেও ভয় দেখান। লখু কাতর ভাবে জানান, ধনকুদরা পুরুলিয়া ছেড়ে কলকাতায় আসতে চাইছেন না।

কেন? এমনিতে বাস্তুভিটে ছাড়তে ভূতের কষ্ট হওয়ারই কথা! ভূশণ্ডী-কাহিনিতে পরশুরাম লিখেছিলেন, “ভূতজাতি অতি নাছোড়বান্দা। ন্যায্যগন্ডা ছাড়িবে না।” সেখানে এই উৎখাত-আয়োজন নিশ্চয়ই ধনকুদরার মনঃপূত হয়নি। তার সঙ্গে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের মতো ভূত-বিশেষজ্ঞ বলছেন, “ভূত তো বায়বীয়! শহরের ধুলো-ধোঁয়া সম্ভবত তার পছন্দ নয়।” ধনকুদরা সম্প্রতি ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ ছবিটি দেখেছেন কি না, জানা নেই। দেখে থাকলে শহরে ভূতেদের স্থানসঙ্কটও তাঁকে ভাবিয়ে তুলে থাকতে পারে। লখু এ বার নিদান দেন, ধনকুদরাকে কলকাতায় আসতে রাজি করাতে গেলে গ্রামে গিয়ে তাঁর পুজো দিতে হবে। ভূত এলেই হাওয়াটা হাঁড়িতে ভরে তিনি কলকাতায় নিয়ে আসবেন। কিন্তু ভূত আনতে গিয়ে লখু নিজেই যে হাওয়া হয়ে যাবেন না, তার নিশ্চয়তা কী?

প্রসেনজিৎ তাই লখুকে ছাড়লেও তাঁর পুত্র ও সঙ্গীদের কয়েক জনকে হোটেলেই আটকে রেখে দেন। এই বার পুলিশের দ্বারস্থ হন লখু। মুচিপাড়া থানার পুলিশ হোটেলে হানা দিয়ে লখুর পুত্র রূপলাল হেমব্রম এবং গ্রামের পড়শি-দম্পতি নিতাই কুম্ভকার ও ভারতী কুম্ভকারকে বন্দিদশা থেকে উদ্ধার করে। লখুদের আটকে রেখে ভয় দেখানোর অভিযোগে জয়ন্ত সাহা এবং দিলীপ মণ্ডলকে গ্রেফতার করা হয়। এঁদের মাথা থেকে ভূত তাড়ানোর দায়িত্ব এখন পুলিশেরই। মূল চরিত্র প্রসেনজিতের খোঁজ চলছে। তিনি বোতলবন্দি হলেই হয়তো জানা যাবে ধনকুদরাকে নিয়ে তাঁর সবিস্তার ভৌতিক পরিকল্পনা।

লখুও অবশ্য বকুনি খেয়েছেন। লোভে পড়ে ভূত বেচতে আসা যে তাঁর ঠিক হয়নি, থানার বড়বাবু সে কথা তাঁকে বলেছেন। লখু এখন ভূতের নামে দিব্যি কেটে বলছেন, “এমন কম্মো আর করব না।”

শুধু গোটা ব্যাপারটায় ধনকুদরা কতখানি মানসিক আঘাত পেয়েছেন, সেটা জানা যায়নি। আনন্দবাজারের তরফে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়েছিল। উত্তর মেলেনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement