গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ ।
লোকসভা ভোটের আগে আনন্দবাজার অনলাইনের শিরোনাম বিকৃত করে ভুয়ো স্ক্রিনশট ছড়িয়ে জনতাকে বিভ্রান্ত করার ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। মঙ্গলবার রাতে বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। এর আগেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তবে আমরা তা উপেক্ষা করারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু এ বার বিষয়টি এত ব্যাপক আকারে ছড়ানো হচ্ছে যে, তাতে পাঠকদের বিভ্রান্ত হওয়ার অবকাশ থাকছে। সে কারণেই আমরা গোটা বিষয়টি সকলের গোচরে আনছি।
২০২২ সালে আসানসোল লোকসভার উপনির্বাচনের সময়ে আনন্দবাজার অনলাইনের নামে একটি জনমত সমীক্ষা ভাইরাল করে দেওয়া হয়েছিল সমাজমাধ্যমে। যাতে এগিয়ে রাখা হয়েছিল তৃণমূলের প্রার্থী শত্রুঘ্ন সিন্হাকে। সেই জনমত সমীক্ষার ফলাফল প্যামফ্লেটের আকারে ছাপিয়ে (এই খবরের সঙ্গে সেই ভুয়ো প্যামফ্লেটের ছবি দেওয়া হল) সেটি দৈনিক খবরের কাগজের মধ্যে ভরে গ্রাহকদের বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করা হয়েছিল।। বাস্তবে আনন্দবাজার অনলাইন তেমন কোনও জনমত সমীক্ষা করেনি। শত্রুঘ্ন যদিও ভোটে বিপুল ভাবে জিতেছিলেন। এ বারেও তিনি আসানসোল কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী।
এ বার আসন্ন লোকসভা ভোটের আগে এখনও পর্যন্ত দু’টি স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়েছে। প্রথমটি অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ছবি দিয়ে। তার শিরোনাম, একান্ত সাক্ষাৎকারে অভিজিৎ জানিয়েছেন, তিনি সানি লিওনির ছবি দেখতে পছন্দ করেন। দ্বিতীয়টি তমলুকের বিদায়ী সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারীর ছবি দিয়ে। তার শিরোনাম, দিব্যেন্দু বিজেপির টিকিট না পেয়ে ক্ষুব্ধ। সেই কারণে তিনি বিজেপিতে যোগ দেওয়া অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে ‘নর্দমার কীট’ বলে কটাক্ষ করেছেন। তাতে দিব্যেন্দুর যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি আনন্দবাজার অনলাইনের একটি খবর থেকে নেওয়া হয়েছে (পাঠকদের সুবিধার্থে সবক’টি স্ক্রিনশটই এই খবরের সঙ্গে দেওয়া হল)। এই দু’টিই ভুয়ো খবর। আনন্দবাজার অনলাইন এই মর্মে কোনও খবর করেনি।
খবর দু’টি দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে সেগুলি ‘তৈরি’ করা হয়েছে। যা সাধারণত রাজনৈতিক দলের আইটি সেলের ‘কারিকুরি’ হয়ে থাকে। যদিও আনন্দবাজার অনলাইনের খবর পরিবেশনা-সহ বিভিন্ন বিষয়ে ‘তৈরি’ করা স্ক্রিনশটটির সূক্ষ্ণ পার্থক্য রয়েছে। খুঁটিয়ে স্ক্রিনশটগুলি দেখলে তা বোঝা যায়। যদিও সাধারণ পাঠকের চোখে তা ধরা না-পড়ারই সম্ভাবনা। তবে ঘটনাচক্রে, এই দু’টি ভুয়ো খবরের মধ্যে কিছু ‘ঘটনাচক্র’ রয়েছে।
আনন্দবাজার অনলাইনের মাস্টহেড ব্যবহার করে এভাবেই ভুয়ো ছবি দিয়ে চলছে প্রচার।
ঘটনাচক্র ১: দু’টি খবরই কলকাতা হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সংক্রান্ত।
ঘটনাচক্র ২: অভিজিতের নাম আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা না হলেও তিনি যে পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে বিজেপির প্রার্থী হচ্ছেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত। মঙ্গলবারেই বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে নন্দীগ্রামে গিয়ে মন্দিরে পুজো দিয়ে এসেছেন অভিজিৎ। তিনি কাঁথিতে শিশির অধিকারীর বাড়িতেও গিয়েছিলেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে শিশির এবং দিব্যেন্দুর দেখা হয়েছে। ফলে তমলুকের বিজেপি প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা সময়ের অপেক্ষা বলেই ধরে নেওয়া যায়।
ঘটনাচক্র ৩: তমলুক লোকসভা কেন্দ্রে তৃণমূলের প্রার্থী হিসাবে দেবাংশু ভট্টাচার্যের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। তিনিও ময়দানে নেমে পড়েছেন। ভোটের প্রচার, দেওয়াল লিখন শুরু করে দিয়েছেন।
ঘটনাচক্র ৪: দেবাংশু তৃণমূলের আইটি সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত। গত বেশ কয়েক মাস ধরে তিনিই আইটি সেলের দেখাশোনা করে থাকেন বলে শাসক শিবিরের লোকজন জানেন।
এই প্রতিটি ‘ঘটনাচক্র’ একে অপরের সঙ্গে জুড়লে যে সামগ্রিক ছবিটি পাওয়া যাচ্ছে, তা ‘কাকতালীয়’ হওয়ার পক্ষে একটু বেশি। এমন আশ্চর্য সমাপতনও সচরাচর দেখা যায় না। তবুও এই অদ্ভুত সমাপতন জনিত প্রতিক্রিয়া জানার জন্য সাংবাদিকতার ব্যাকরণ মেনেই আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে মঙ্গলবার রাতেই দেবাংশুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। হোয়াট্সঅ্যাপে তাঁর ফোনে পাঠানো বার্তারও কোনও জবাব আসেনি।
সমাজমাধ্যমের এই রমরমার সময়ে ভুয়ো খবর নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। যা নিয়ে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রায়ই ক্ষোভপ্রকাশ করেন। তিনি আগে বলেছেন, “বাংলাদেশের ঘটনাকে বাংলার বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে!” মুখ্যমন্ত্রীর সে উদ্বেগে খাদ নেই। সত্যিই বাংলাদেশের একটি ঘটনার ছবিকে পশ্চিমবঙ্গের ছবি বলে ভাইরাল করে দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট লোকজনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছিল। তবে পাশাপাশি এটিও সত্য যে, আনন্দবাজার অনলাইনের বিশ্বাসযোগ্যতার কারণেই রাজনীতির কারবারিদের একাংশ আমাদের মাস্টহেড ব্যবহার করে এই ধরনের ভুয়ো খবরের স্ক্রিনশট ছড়াচ্ছেন। অর্থাৎ, যাঁরা এ কাজ করছেন, তাঁরা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিচ্ছেন, আনন্দবাজার অনলাইনের খবর বললে বা আনন্দবাজার অনলাইনের লাল-সাদা মাস্টহেড ব্যবহার করলে তা ‘বিশ্বাসযোগ্য’ হয়! সেটা আমাদের কাছে একপ্রকার শংসাপত্রও বটে।
কিন্তু খবরটি ভুয়ো কি না, তা বোঝার সহজ উপায় রয়েছে।
আনন্দবাজার অনলাইনের খবরের শিরোনামের স্ক্রিনশট হয়ে যা যা বিভিন্ন ইনবক্সে ঘোরে বা ফেসবুক অথবা এক্সের (সাবেক টুইটার) ফিডে ভেসে বেড়ায়, সেগুলি সত্য কি না, তা যাচাই করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনের বাংলা শিরোনামটি গুগলে গিয়ে ‘সার্চ’ করুন। তা হলেই জানা যাবে আনন্দবাজার অনলাইন ওই খবর প্রকাশ করেছে কি না। সাধারণত এই ধরনের ভুয়ো খবরে মাস্টহেড-সহ শিরোনামের স্ক্রিনশট ছাড়া আর কিছু থাকে না। সচেতন পাঠক মাত্রেই জানেন, শুধু শিরোনাম দিয়ে কোনও খবর হয় না। শিরোনামের পরে পুরো খবরটি থাকে। তা ছাড়াও, আনন্দবাজার অনলাইনের বিশেষ ‘ফন্ট’ রয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুয়ো স্ক্রিনশটে ভিন্ন ‘ফন্ট’ ব্যবহার করা হয় এবং হচ্ছে। তবে এই ধরনের কারিগরেরা ক্রমশ তাঁদের কাজে দড় হয়ে উঠছেন। ফলে তুলনায় কাছাকাছির ‘ফন্ট’ও ব্যবহার করা হচ্ছে। সেই কারণেই প্রাথমিক সাবধানতাটুকু আরও জরুরি।